শনিবার ৮ আশ্বিন, ১৪৩০ ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ শনিবার

‘আমার গল্প’ নামক আত্মজবানীতে ফরিদ কবির লিখেছেন

অনলাইন ডেস্ক : ‘আমার গল্প’ নামক আত্মজবানীতে ফরিদ কবির লিখেছেন “পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যেমন আকস্মিকভাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দে চলে এসেছিলেন, মতিউর রহমানের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই ঘটেছিল”। ফরিদ কবির ছিলেন দৈনিক আজকের কাগজ ও দৈনিক ভোরের কাগজের সিনিয়র সাংবাদিক। এই আলাপের একটা নাতিদীর্ঘ পূর্বাপর আছে, পরম্পরা আছে। সেখান থেকে একটু ঘুরে আসি।
১৯৮৮ শেষের দিকে নাঈমুল ইসলাম খানের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক খবরের কাগজ বেরিয়েছিল। মূলত নির্বাহী সম্পাদক জিল্লুর রহমান(তৃতীয় মাত্রা) এটার উদ্যোক্তা ছিলেন। নাঈমুল ইসলাম খানের ঘটকালিতে এতে কাজী শাহেদ আহমেদ অর্থায়ন করে কাজী শাহেদ আহমেদ প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এরশাদের সরকার একবার বন্ধও করে দিয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ে চালু হয়েছিল। সাপ্তাহিক খবরের কাগজেই ১৯৯০ সালের ২৫শে অক্টোবর ৯ম বর্ষ ৪৩ সংখ্যায় ছাপা হলো ‘জয় বাংলা’। তাতে লেখা হলো- জয় বাংলা বাঙালিদের জাতীয় স্লোগান। এই স্লোগানের কোনো রকম পরিবর্তন, পরিবরধন, সংশোধন তথা বিকৃতিকরণ একটি ক্ষমাহীন জাতীয় অপরাধ।
এই সাপ্তাহিক খবরের কাগজই পরে দৈনিক আজকের কাগজ হয়েছিল। সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, প্রধান সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ। ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ডামি ছাপা হবার পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল। আজকের কাগজে ইমপ্রেস গ্রুপের অর্থাৎ ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ প্রমুখদেরও কিছু বিনিয়োগ ছিল। সাপ্তাহিক পত্রিকাকে দৈনিকে পরিণত করা পুরনো রেওয়াজ। ব্রিটিশ আমলে ‘দি মুসলমান’ প্রথমে সাপ্তাহিক, পরে সপ্তাহে তিনদিন এবং ১৯২৯ সালে দৈনিক হিসেবে বেরিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশে যায়যায়দিন; একইভাবে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে পরিণত হয়েছিল।
জীবনের শিলালিপিতে কাজী শাহেদ আহমেদ লিখেছেন, “আজকের কাগজ ছিল মূলত একটা আন্দোলন, একটা বিপ্লব। আজকের কাগজের দর্শন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুজ্জীবিত করা।“ স্পষ্টতই এতে সমাজ ও সংস্কৃতি আছে এবং অনিবার্যভাবেই অর্থনীতি আছে; যার টোটালিজেশন রাজনীতি। এই ভূখণ্ডে, এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক প্রয়োজনেই মূলত পত্রপত্রিকার যাত্রারম্ভ। ধূমকেতু, নবযুগ, লাঙ্গল/গণবাণী, মর্নিং নিউজ, ডন, আজাদ, মিল্লাত, ইত্তেহাদ ইত্যাদির নাম করা যায়। পাকিস্তান আমলে সৈনিক, ইত্তেফাক, সংবাদ, মিল্লাত, মর্নিং নিউজ, জনতা, হলিডে, গণবাংলা, ডেইলি পিপলস এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলার বাণী, গণকণ্ঠ, হক-কথা, হলিডে ইত্যাদির নামোল্লেখ করা যায়। বলাবাহুল্য সংগ্রাম, দিনকাল, আমার দেশ, নয়াদিগন্তও রাজনৈতিক পত্রিকা। কাজী শাহেদ বাংলাদেশের মূলধারার প্রতিনিধিত্বশীল পত্রিকা গড়তে চেয়েছিলেন।
দৈনিক আজকের কাগজের জন্য কাজী শাহেদ আহমেদকে প্রায় ৬০০ দিনের বেশি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। হাজত ভোগ করতে হয়েছে। ৮৭ টা মামলার আসামী হতে হয়েছে। ১৯৯১ সালে মাত্র বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। সৈয়দ বোরহান কবীরের সিরিজ লেখার মধ্যে একটি ছিল ‘অতীতে দুর্নীতি করার কারণে তারা জেলে গিয়েছিল’। নতুন মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও মেজর জেনারেল মজিদ-উল হককে নিয়ে লেখা।
এরপরে দ্রুততম সময়ে মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, বাসা-অফিস ঘেরাও, ধানমন্ডি থানায় আটক এবং পরেরদিন কোর্ট থেকে জামিন। ১৯৯১-৯৬ বিএনপি আমলেই কাজী শাহেদ আহমেদের নামে হুলিয়া জারি হয়েছিল। রাবি ভিসিও একবার মামলা করেছিল। কাজী শাহেদের ভাষ্যে- এটাকে কোর্ট মামলার হাতেখড়ি ছিল বলা যেতে পারে। পরে যে আরও কত মামলা হলো। কতবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু কোনোদিনও কোনো রিপোর্টারকে দোষারোপ করি নাই।
আজকের কাগজেই মতিউর রহমানকে পাওয়া যায়। কাজী শাহেদ আহমেদের নিজস্ব বয়ানে এরকম-
“নাঈম(নাঈমুল ইসলাম খান) একদিন এসে আমাকে বলল, মতি ভাইয়ের(মতিউর রহমান) পত্রিকা তো বন্ধ তাই সে একটু অসুবিধায় আছেন। উনি শুধু একটা কলাম লিখবেন, আজকের কাগজে একটু জায়গা চাচ্ছেন। বললাম বেশ দাও জায়গা। মতিউর রহমানের কলামের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শীর্ষ কলাম’। তিনি আসেন। বসেন। তরুণ সাংবাদিকরা তাকে খুবই পছন্দ করে। আর পছন্দ করার মতোই লোক তিনি। বামপন্থী লোক, কমিউনিস্ট মানুষ, আজকের কাগজের বেশির ভাগ সাংবাদিক বাম ঘরানার। এরমধ্যেই ‘সময়’ নামে একটি সাপ্তাহিক খুলেছিল নাঈমুল ইসলাম খান। আজকের কাগজের পাশের গলিতেই অফিস। ওখানেই মতিউর রহমানের আড্ডাখানা। মিষ্টি লোক। মিষ্টি কথাবার্তা। অচিরেই মতিউর রহমান সবাইকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিল।” নাঈমুল ইসলাম খানের ভাষ্যে কাজী শাহেদ আহমেদ লিখেছেন ‘মতিউর রহমানের একতা পত্রিকা বন্ধ’ এ-কথা সঠিক নয়। কমিউনিস্ট পার্টিতে মতিউর রহমান ছিলেন বিলোপবাদী, তাই একতা পত্রিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তিনি বিচ্যুত। এরপরে একতা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন কমরেড অজয় রায়।
আজকের কাগজের ভাঙ্গাগড়ায় অনেক লোকের নামোল্লেখ করেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ, সেসব এখানে উল্লেখের প্রয়োজন নাই। শুধু চুম্বক অংশটুকু উল্লেখ করছি।
মতিউর রহমানের পরিকল্পনায় দৈনিক আজকের কাগজকে বসিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের ভাগিয়ে নতুন পত্রিকা করাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। একজন কর্নেল ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বাম ঘরানার তরুণদের গরম করতে সম্ভবত বেশি বেগ পেতে হয়নি। তারা বলতে শুরু করেছে, তাদের মেধা আর খাটনিতে তৈরি পত্রিকার মালিক অন্য লোক। নতুন পত্রিকা হলে তারাও মালিকানার অংশ পেতে পারে এমন আশাও সবাইকে দেওয়া হয়েছিল। সেই আশা কতটা পূরণ হয়েছে তা তারাই বলতে পারবে। আজকের কাগজ তখন মাসে ১২-১৪ লাখ টাকা করে প্রফিট করতে শুরু করেছে। কিন্তু দু’মাসও যেতে পারল না। তরুণ সাংবাদিকদের ক্ষেপিয়ে তুলল। সবাই মিলে একটা দাবিনামা তৈরি করল। একদিন তারা নিজেরাই মিটিং ডাকল। আমিও সেখানে গেলাম। তাদের দাবিনামা আমাকে দেওয়া হলো। দাবির মোদ্দাকথা, সাংবাদিক আর রিপোর্টাররা আজকের কাগজের মালিক হবে। আমি ইচ্ছা করলে কিছু শেয়ার নিয়ে তাদের সঙ্গে থাকতে পারি। প্রায় চৌদ্দটার মতো পয়েন্ট উল্লেখ আছে কী কী করতে হবে। এই দাবিনামা পেশেরর আগে মতিউর রহমান একটা কলাম লেখেন ‘পত্রিকার মালিক থাকবে নক্ষত্র দূরে’। সেটা কেটে কেটে পত্রিকা অফিসের সব দরজায় পেস্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমার আর বুঝতে বাকি থাকল না, এর পেশনে কে অনুঘটকের কাজ করছে।” এই শিরোনাম থেকেই অনুমিত হয় ভোরের কাগজের পরে প্রথম আলো গড়তে লতিফুর রহমানের মতো মালিক কেন খুঁজে নিয়েছিলেন!
ইতোমধ্যে কাজী শাহেদ জেনেছেন নাঈমুল ইসলাম খান ও মতিউর রহমান প্রমুখ পরিবাগে অফিস নিয়েছে। নতুন পত্রিকা বের করবে। একবার নাঈমুল ইসলাম খানকে সম্পাদক থেকে বাদও দিয়েছিল। সেজন্য যেদিন কাজী শাহেদের মা মারা যান সেদিন নাঈমুল ইসলাম খান কয়েকজনকে নিয়ে কাজী শাহেদের বাসায় হুলস্থুল কাণ্ড করেছিল। পরে সম্পাদক পদে বহালও করেছিল।
এক বছরের মাথায় কাজী শাহেদ আহমেদ নাঈমুল ইসলাম খান, মতিউর রহমান ও বেনজীর আহমেদকে বের করে দিয়ে ১৯৯২ সালের ২৯ জানুয়ারি আজকের কাগজ পুরো নিজের দখলে নিলেন। পরেরদিন পত্রিকায় ‘নাঈমুল ইসলাম খান আজকের কাগজ থেকে পদত্যাগ করেছে’ শিরোনামে সংবাদ বেরিয়েছিল। সে রাতেই নাঈমুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ১৬০ জন সাংবাদিক আজকের কাগজ ছেড়ে দিয়েছিল।
এরপরে সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মতিউর রহমান চৌধুরী। ২/৩ মাস পরে তিনিও পরিকল্পিতভাবে পদত্যাগ করে বেরিয়ে গিয়ে বাংলাবাজার পত্রিকা বের করলেন। আজকের কাগজও কাজী শাহেদ আহমদের নেতৃত্বে চলতে চলতে ২০০৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
সম্পাদক বদল, মালিক বদল এটাই নতুন না। বাংলাদেশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং ব্রিটিশ আমলেও এরকম বহু নজির আছে। আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর ও আত্মকথা, আবুল কালাম শামসুদ্দীনের অতীত দিনের স্মৃতি, মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সাংবাদিকের রোজনামচায় এসবের বিশাল বিশাল ফিরিস্তি পাওয়া যায়।
ফরিদ কবির ‘আমার গল্পে’ লিখেছেন- “আজকের কাগজ ও ভোরের কাগজের গল্পের চাইতে উত্তেজনাময় গল্প নব্বইয়ের দশকে আর ঘটেনি। এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন, এরশাদের পতন ও বিএনপির ক্ষমতাগ্রহণের পরে এ দুটি দৈনিকের উত্থান ও পতনের ঘটনাই সবচাইতে আলোচিত বিষয় ছিলো বলে আমার ধারণা। মতিউর রহমান আজকের কাগজে একজন পার্টটাইম সাংবাদিক ছিলেন। মাঝেমধ্যে রাজনীতি বিষয়ে একটা দুটো প্রতিবেদন লিখে দিয়ে যেতেন। তার কোনো নির্ধারিত চেয়ার-টেবিলও ছিলো না। কাজী শাহেদ আহমেদ ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন ও দৈনিকের পূর্বনির্ধারিত ৩৩ শতাংশ শেয়ার দিতে রাজি না হওয়ায় আজকের কাগজের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।” ভাঙন প্রসঙ্গে কাজী শাহেদ আহমেদের বক্তব্য আগেই উল্লেখ করেছি। তাই ফরিদ কবিরের এই কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কাজী শাহেদ আহমেদ ও ফরিদ কবির দুজনের বই পড়ে এবং ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণে মনে হয়েছে ফরিদ কবির অনেক বিষয়েই ভেতরের খবর জানতেন না। নাঈমুল ইসলাম খানের ঘনিষ্ঠ সহচর হলেও ফরিদ কবির এসব খেলাধুলায় অপারঙ্গম ছিলেন বলেই হয়ত নাঈমুল ইসলাম খান তাঁকে জড়াতেন না কিংবা এড়িয়ে যেতেন। ফরিদ কবির মূলত ভীষণরকম আর্থিক প্রয়োজনে পত্রিকায় কাজ করতেন। এজন্যই আমার এই বাড়তি মন্তব্য।
১৯৯২ সালের ২৯ তারিখ আজকের আগজ থেকে বেরিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারিতেই ভোরের কাগজ বাজারে বেরোতে শুরু করেছিল। সেদিন অন্যান্য পত্রিকায় ভোরের কাগজের বিজ্ঞাপন ছিল ‘আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি আ জ কে র কা গ জ- ভোরের কাগজ’। এটি তৈরি করেছিলেন অভিনেতা ও শিল্পী আফজাল হোসেন। কাজী শাহেদ আহমেদের তথ্যই সঠিক। পূর্বপ্রস্তুতি চলছিল আগে থেকেই।
ভোরের কাগজের অগ্রযাত্রাও বেশিদিন অব্যাহত থাকেনি। কয়েক মাসের মধ্যেই ভোরের কাগজেও ভাঙনের সুর বেজে উঠেছিল।
ফরিদ কবির জানিয়েছেন- ‘সেই সুর প্রথম আমার কানে তুলে দিলেন মতি ভাই, মানে মতিউর রহমান। এরপরই দ্রুত একের পর এক ঘটনা ঘটতে শুরু করলো! মুঘল সাম্রাজ্যের মতোই এখানেও হদিস পাওয়া গেলো পাসাদ(!) ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস আর দলাদলির। আমি ছিলাম এসব ঘটনার বাইরের একটা চরিত্র। এক সময় লক্ষ্য করলাম, সেই ঘটনায় আমিও ঢুকে গেছি! নিজেরই অজান্তে! আমার চরিত্রেরও বদল ঘটলো। আমি ছিলাম নাঈমের ঘনিষ্ঠ সহচর। কিন্তু দাঁড়ালাম নাঈমেরই বিরুদ্ধে। আমার যদিও তখন মনে হয়েছিলো, ন্যায়ের পক্ষেই দাঁড়িয়েছি আমি! এখন বুঝি, যে সত্য আমরা জানি, তা আসলে অর্ধসত্য। পুরো সত্য বলতে আসলে কিছুই নাই। আজকের কাগজ থেকে যে কারণে সবাই বেরিয়ে এসেছিল, ভোরের কাগজেও সবার বিশ্বাস ছিল পত্রিকা মুনাফা করলে সংবাদকর্মীরাই লাভবান হবে। সবাই এরকম একটা ইউটোপিয়াতে ভুগতেন যে, কিছুদিনের মধ্যেই সংবাদকর্মীদেরকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার ভাগ করে দেয়া হবে। আজকের কাগজের পরে ভোরের কাগজে যোগ দিলেও মতিউর রহমান ছিলেন অনেকটা আউটসাইডার। এতোটাই এলিয়েন ছিলেন যে তাঁর নাম যখন প্রিন্টার্স লাইনে নাঈমুল ইসলাম খানের নামের নিচে প্রধান সম্পাদক হিসেবে ছাপা হতে শুরু করে, তখন অনেকেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। কেউ কেউ আপত্তিও করেছিলো।”
পরে আসল ঘটনা বেরিয়ে এলো। মতিউর রহমানের বিনিয়োগ আছে। এজন্যই প্রিন্টার্স লাইনে তাঁর নাম যায়! ভোরের কাগজ পরিচালনার এত টাকা কোত্থেকে এসেছে এ-সম্পর্কে সংবাদকর্মীদের কোনো ধারণা ছিলো না। তাই তারা এসব জানতেন না, বুঝতেনও না। নাঈমুল ইসলাম খান এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েই সবাইকে আজকের কাগজ থেকে বের করে এনেছিলেন। তখন মতিউর রহমান ছিলের আড়ালের খেলোয়ার। এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করলেন।
ভোরের কাগজ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে জয়েন্ট স্টক কোম্পানী থেকে একুশে পাবলিকেশনস লিমিটেড নামে প্রকাশনা কোম্পানীও করেছিলেন দুজনে। অনেকের মনে থাকার কথা একুশে নামে আজিজ মার্কেটে একটা বইয়ের দোকানও ছিল। একুশের স্টাফ দিয়েই পরে প্রথমার যাত্রা শুরু। সেই একুশে…
একুশে পাবলিকেশনস লিমিটেডে কোম্পানীর এমডি নাঈমুল ইসলাম খান, চেয়ারম্যান মতিউর রহমান এবং পরিচালক ছিলেন মালেকা বেগম, মঞ্জুরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান এবং নাঈমুল ইসলাম খানের ভাই-বোন আরও পাঁচজন সদস্য।
অথচ সংবাদকর্মীদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল মালিকানা দেয়া হবে। উল্টা এসব কি? এসব বাইরের কারোরই জানা ছিলো না। মতিউর রহমান তখন প্রকাশ্যে লগ্নিকৃত টাকা ফেরত চাইছিলেন আর গোপন ইচ্ছা গোপনেই রেখেছিলেন। তাই মতিউর রহমানই প্রথমে ফরিদ কবিরকে এসব দলিলাদি দেখিয়েছিলেন। নাঈমুল ইসলাম খানের ঘনিষ্ঠ সহচর হলেও ফরিদ কবির এটা মানতে পারেন নি। নাঈম বলেছিল কি আর করেছে কী?
এরপরেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করলো। অমিত হাবিবের হাতিরপুলের বাসায় কিংবা ফরিদ কবিরের বাসায় সিনিয়র সাংবাদিকদের মিটিং চলতে থাকলো। বিস্তারিত শুনে সবাই ক্ষেপে উঠলো। পুরো সমর্থন দুদিনের মাথায় নাঈমের বিরুদ্ধে ভলে গেলো। পুরো ভোরের কাগজ ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠলো।
এরপরে একদিন অফিসে মিটিং বসলো। মতি ভাই বললেন, আমার টাকা দিয়া দেন, আমি চলে যাই। নাঈম এক বছরের সময় চেয়ে বললো ইন্টারেস্টসহ দিবে। তখন কার কত টাকা ইনভেস্ট বেরিয়ে এলো।
ফরিদ কবির লিখেছেন, “মতি ভাই জানালো ২৪ লাখ টাকা দিয়েছে। নাঈম বলল সাত লাখের কথা। এই নিয়ে উত্তেজনা। সবাই কনফিউজড কে সত্য? হঠাৎ মতি ভাই বললো, আপনি কত ইনভেস্ট করেছেন? নাঈমের উত্তর প্রায় দশ-বারো লাখ টাকা। মতি ভাই ধুম করে বলে বসলেন, তাইলে আমিই আপনাকে এই টাকাটা দিয়ে দিচ্ছি, আপনিই চলে যান। নাঈম ভড়কে গেলো। ভয়ানক রেগে গেলো। মতি ভাই বেশ ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। তিনি ঠাণ্ডা গলাতেই বললেন, এটা সবার কাগজ। এখানে আপনার ইনভেস্টমেন্ট যা আছে তা আমি দিয়ে দিচ্ছি। আপনি কাগজ ছেড়ে চলে যান। সবাই চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ আপনি চলে যান। মতি ভাই আপনি টাকা দিয়ে দেন।
মতি ভাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা চেক লিখে নাঈমের হাতে দিলেন।
নাঈম একেবারেই হতবাক হয়ে গেলো। রাগে-দুঃখে সে একেবারেই কেঁদে ফেললো। একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলো। কিন্তু তার কথা তখন মূল্যহীন। সে তাকিয়ে দেখলো, যাদের সে বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে তিলতিল করে গড়ে তুলেছে, আজ তারাই তাকে, তার স্বপ্নের কাগজ থেকে বের করে দিচ্ছে। আজকের কাগজের নায়ক মুহূর্তে যেন খলনায়কে পরিণত হলো। নাঈম মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো।” ব্রিটিশ আমলে দৈনিক আজাদের সম্পাদক নজির আহমদ চৌধুরীর যেভাবে একমুহূর্তেই পদ নাই হয়ে গিয়েছল, সেরকম নাই হয়ে গেলো নাঈমুল ইসলাম খানের পদ।
সেই থেকে ভোরের কাগজে মতিউর রহমানের যুগ শুরু।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় নাঈমুল ইসলাম খান ও মতিউর রহমান দ্বন্দ্বে মতিউর রহমানই সঠিক ছিলো। কিন্তু না। আজকের কাগজে থাকতেই দুজনের পরিকল্পনায় নাঈমুল ইসলাম খান সকল সংবাদকর্মীদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলো সবাই মালিক হবে। এই স্বপ্নে বিভোর হয়েই ১৬০ জন সাংবাদিক আজকের কাগজ ছেড়েছিলেন। ভোরের কাগজে গোপনে কয়েকজন মিলে মালিক হলেন। স্বপ্নভঙ্গের তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বলি হয়েছিলেন নাঈমুল ইসলাম খান। ফরিদ কবির উল্লিখিত ৩৩% কিংবা কাজী শাহেদ আহমেদ উল্লিখিত শ্রমিক হবে মালিক এটা কিন্তু বাস্তবায়ন করেন নি মতিউর রহমান। উল্টা আরও কি কি করেছিলেন সেসবের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
ফরিদ কবিরকেও মতিউর রহমান উপযুক্ত প্রতিদান দিয়েছিলেন! প্রথমে খুব গুরুত্ব দিতেন। এসবের মধ্যে সত্যি সত্যি আমি ধরতেই পারিনি, মতি ভাই যে খুব গোপনে আমার কবর খুঁড়তে শুরু করে দিয়েছেন। তার হাতে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছেন। পরীবাগ থেকে পুরানা পল্টনে জুয়েল হাউজে নতুন অফিসে। সেখান থেকে বাংলা মোটরে। আর চলছিল ছাটাই দায়িত্ব বণ্টন ও নতুন নিয়োগ।
ফরিদ কবিরের দায়িত্ব ক্রমাগত ছোট হতে শুরু করলো এবং ধীরে ধীরে সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে দিলো। এভাবেই চলছিল প্রায় ৩ বছর। বুঝলেও কিছুই করার নাই। কারণ চাকরি ছাড়ার মতো অবস্থাও নাই। মতিউর রহমান যখন কথা বলাও বন্ধ করে দিলেন তখন আর কুলাতে না পেরে ১৯৯৬ সালের একদিন হুট করে ইস্তফা দিয়ে দিলেন।
এখানেই শেষ না। ফরিদ কবিরের বেতন ও গ্র্যাচুইটি নিয়েও লম্বা কাহিনি হয়েছে। ফরিদ কবির বলছেন, “সব সময় জেনে এসেছি সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। কিন্তু আমি দেখতে পেলাম এই বিবেকের বুক ঘুণে খেয়ে ফেলেছে। যখন পাওয়া টাকার জন্য অফিসে গিয়েছেন তখন দেখলেন সাবেক সহকর্মীদের কেউ আমাকে বসতে বলেন না, পাছে মতি ভাইয়ের কু-নজরে পড়েন।” শেষ পর্যন্ত উকিল নোটিশ পাঠিয়ে এক লাখ বারো হাজারের মধ্যে কয়েক কিস্তিতে ৮৮ হাজার নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মতিউর রহমানের অভিন্নহৃদয় বন্ধু আবুল হাসনাতের প্রসঙ্গটিও মনে পড়লো। ‘হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে’ বইতে জানিয়েছেন একই অভিজ্ঞতার কথা। ২০০০ সালে সংবাদ ছাড়ার দুবছর বাদে ড আনিসুজ্জামান স্যারের অনুরোধে আহমেদুল কবিরের স্ত্রী মিসেস লায়লা কবির আবুল হাসনাতের মেয়ের বিয়ের সময় দুই লাখ টাকা পাওনা থেকে প্রদান করেছিলেন। বাকী সাড়ে তিন লাখ টাকা অনেক অনুরোধে আলতামাস কবিরের বোন নিহাদ কবির কয়েক বছর বাদে এনে দিয়েছিলেন।
ফরিদ কবির জানিয়েছেন ইতোমধ্যে ভোরের কাগজের মালিক হিসেবে যোগ দিয়েছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। ফরিদ কবিরের এই শেষবেলায় জানতে পারাটা তাঁর অজ্ঞতা। কারণ আজকের কাগজ জমানাতেই কাজী শাহেদ আহমেদ এটা জানতেন এবং সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে মিটিং-ও করেছেন। সুতরাং ফরিদ কবির এবং অপরাপর সাংবাদিকরা যা ভেবেছেন এবং যেসব ঘটনার ভেতরে প্রবেশ করেছেন; সেসবের জন্য দীর্ঘদিনের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল।
এভাবেই শুরু দৈনিক সংবাদমাধ্যমে মতিউর রহমানের যুগ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পরে এদেশে যারা তত্ত্ব হাজির করেছিলেন যে, সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নাই; মতিউর রহমান তাদের অন্যতম। সেই মতিউর রহমান সাপ্তাহিক একতা থেকে নাঈমুল ইসলাম খানের মাধ্যমে দৈনিক আজকের কাগজে প্রবেশ করে দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক হন। একসময় সেখান থেকে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম আলো। এভাবেই অনেক পত্রিকা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমগুলো রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বদলে কর্পোরেট বণিকদের ব্যবসায় সহযোগিতার অঙ্গীকারে নাম লেখায়।
নব্বইয়ের দশকে বিশ্বজুড়ে কমিউনিজম পতনের দিকে ধাববান। নিওলিবারেলরা তখন সিভিল সোসাইটির প্রসঙ্গ সামনে আনতে শুরু করছে। সিভিল সোসাইটি দিয়ে রাষ্ট্র-ক্ষমতা কব্জা করবে, এরকম আর কি। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে নিওলিবারেলদের প্রধান মুখপত্র হয়ে উঠলেন মতিউর রহমান। প্রায় তিরিশ বছরের বাম-রাজনীতি করার প্রভাব না-থাকার কোনো কারণ নাই। আবুল মনসুর আহমদ তিরিশ-চল্লিশের দশকে সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক নিয়ে যেসব বয়ান দিয়েছেন সেসব তো না-জানারও কথা না। তাই মালিকানার পথেও অগ্রসর হয়েছেন মতিউর রহমান। ব্রিটিশ আমলে দি পিপলস পত্রিকার সম্পাদক মৌলভী মুজীবুর রহমান তাঁর ভাতিজা মোহাম্মদ মোদাব্বেরকে বলেছিলেন-‘সাংবাদিকতা ও রাজনীতি এক সঙ্গে করা যায় না, এতে সাংবাদিকতার পূর্ণ বিকাশ ব্যাহত হয়।“ মুজীবুর রহমান নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, “এটা আমার পেশা নয়। দায়ে পড়ে সাংবাদিক হয়েছি। আসলে আমার লক্ষ্য রাজনীতি।” মতিউর রহমান সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিকে বিদায় দিয়ে। এখন দেখা যাচ্ছে তিনি মূলত রাজনীতি-ই করছেন। অনেকটা তারেক রহমানের মতো রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে লন্ডন গিয়ে আবার রাজনীতিই করছেন। পার্থক্যও আছে-মতিউর রহমান স্বেচ্ছায় রাজনীতি ত্যাগ করেছিলেন। আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইতে একটা কথা লেখা আছে- ‘সমস্ত রাজনীতিক সত্যের উপর আরেকটা বড় সত্য আছে। সেটা বাঙালি জাতির অস্তিত্ব।‘ এই অস্তিত্বকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করে আলুপোড়া খেতে চাইলে সেটার জবাব পেতেও দেরি হবেনা। এটাই স্বাভাবিক।
মতিউর রহমান সাংবাদিকতার যাত্রাপথে পেয়েছেন সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক ভোরের কাগজ এবং দৈনিক প্রথম আলো। এভাবেই এরপর থেকে বাংলাদেশে কোকাকোলা-পেপসির বুদ্বুদের মতো বুদ্বুদ তৈরি হতে শুরু হয়েছে।
যেকোন ঘটনা বা বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ঘটনার বিশ্লেষণে ব্যক্তি চরিত্রও বিশ্লেষণের মধ্যে চলে আসে। মতিউর রহমানও এসেছে। নাঈমুল ইসলাম খানও এসেছে।
কাজী শাহেদ আহমেদ প্রশ্ন করেছেন “আজ আমার জানতে ইচ্ছে করে- এখন যখন মতিউর রহমান প্রথম আলোর আংশিক মালিক ও সম্পাদক, তিনি কি এই দাবি-দাওয়া প্রথম আলোর ক্ষেত্রে পালন করছেন?”

Categories: অর্থনীতি,জাতীয়,রাজনীতি,সারাদেশ

Leave A Reply

Your email address will not be published.