শনিবার ৮ আশ্বিন, ১৪৩০ ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ শনিবার

বই পড়া, বই কেনা

অনলাইন ডেস্ক– আমার দার্শনিক ও কবিবন্ধু ডিআইজি মুনীরুজ্জান একদিন গর্বভরে বললেন, আমি যত বই পড়েছি তত বই তুই জীবনে চোখেও দেখিস নি।

তুই কত বই পড়েছিস, বুদ্ধু?আমার মনে হয় ৮- ১০ হাজার বই পড়েছি আমি । আমার স্ত্রী ১০টা বই পড়েছে কিনা সন্দেহ। আউট বই পড়লে জ্ঞান বাড়ে ছোটো বেলায় শুনেছিলাম বড়দাদার কাছে, যদিও তিনি আউট বই পড়তেন না মোটেই।

আমি পড়া শুরু করি এইটে থাকতে। স্কুল লাইব্রেরি চষে বেড়িয়েছি। কলেজের লাইব্রেরি, কিশোরগঞ্জের পাবলিক লাইব্রেরি তন্ন তন্ন করে পছন্দমত বই পড়েছি। ক্লাস বাদ দিয়ে লাইব্রেরিতে আউট বই পড়েছি। কলেজে পড়ার সময় ট্রেনে যাতায়ত করতাম। ট্রেনের টাইমের ঠিক ঠিকানা ছিল না।

সকালের ট্রেন দুপুরে, বিকেলের ট্টেন গভীর রাতে আসত। আমার কোন টেনশন ছিল না, কারণ আমি বা আমরা বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করতাম। পেটের ক্ষুধা জ্বালালেও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। টিকেট চেকাররাও সদয় থাকতেন। চাপাচাপি করতেন না।

স্টেশনের স্টল থেকে সস্তা নিউজ প্রিন্টের বই কিনে পড়তাম। স্টেশনে বসে, চলতি ট্রেনে বসে। মাসুদ রানা, কুঁয়াশা, দস্যু বনহুর, নিহার রঞ্জন, আশুতোষ, নিমাই, বিমল মিত্র, ফাল্গুনি, গজেন্দ্র কুমার… এইসব গোগ্রাসে গিলেছি স্কুল আর কলেজে। তেমন কোনো কাজে আসেনি। জ্ঞানও তেমন বাড়েনি।

মাঝখান থেকে পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। পরে যখন বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, মাণিক, বিভূতি, বুদ্ধদেব, তারাশঙ্কর, অচিন্ত্য, অন্নদা শংকর পড়া শুরু করলাম ততদিনে কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে পৌঁছে গেছি।

তারপর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতন্ত্র, কার্লমার্কস, হেগেল, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, জা পল সার্ত্রে, বেদ, মহাভারত, রামায়ন, ভাগবত, গীতা, কোরআন, বাইবেল…. কত কি পড়েছি! সোভিয়েট ও ফ্রান্স সাহিত্যের প্রচুর অনুবাদ পড়েছি। টলস্টয়, ডক্টয়ভস্কি, ইভান তুর্গেনিভ, চেখভ গোগোল, বালজাক, এমিল জোলা, সার্ত্রে, ফ্লবেয়র পড়েছি। আনা কারেনিনা, ওয়ার এন্ড পিস, মাদাম ব্যুভারী পড়ে স্তম্ভিত হয়েছি।

সুন্দরী প্রাণবন্ত নাতাসা, ভাগ্য বিড়ম্বিত রাসকিলনকভ, এমা বোভারীর জীবনের রং আজও মনে রয়ে গেছে। ইউনভারসিটিতে দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই কর- এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। তারপর ১ বছর ক্ষেতমজুর সংগঠন। পালিয়ে বেড়ানো। চোখে লেনিন, চে গুয়েবারা হওয়ার স্বপ্ন… তারপর বিসিএস।

সব গেল ভেসে। লেফ্ট রাইট লেফ্ট রাইট, রাইফেলের গুলির নিশানা। তো আশ্চর্য বিষয় আমি যা পড়েছি তা দর্শন, উপন্যাস, সমাজ বিজ্ঞান, আইন যাই হোক, কেমন করে যেন মনে থেকেছে। তেমন ভুলিনি। কেবল নিজের সাবজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং পুরোপুরি ভুলে গেছি পাশ করার পর। মগজ বুঝে গেছিল প্রকৌশল সংক্রান্ত জ্ঞানকে ভালবাসি না, তাই ডেলিট হয়ে গেছে। বাইবেল, রামায়ন, মহাভারতের কাহিনী যেন আমার নখ দর্পনে আজও।

গত ১০/১২ মাসে পরখ করলাম, আগের স্মরণ শক্তি আছে কিনা। বেদ মুখস্থ রাখতে পারি কিনা? কি আশ্চর্য দেখলাম ছন্দের মিল, কোথায় জানি অন্তমিল ধরে ফেলি। মুখস্থ হয়ে যায়। এইভাবে ঋকবেদের ঈশা উপনিষদে ১৮ টি, অথর্ববেদের মুন্ডক উপনিষদের ৩২ টি এবং যজুর্বেদের শ্বেতশ্বতর উপনিষদের ৩৫ টি শ্লোক মুখস্থ হয়ে গেছে।

যখন তখন কোট করতে পারি। গতকাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যলয়ে ঈশা আর মুন্ডক থেকে ৪/৫ টি বৈদিক শ্লোক বলে এর ব্যাখা করেছি, সময় চলে গেছে ২০ মিনিট। এই আউট বই পড়ে পড়ে আমার ইউনিভারসিটির রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। না হয় টিচার হওয়া যেত। পুলিশ জীবনে অনেক বই কিনেছি। পড়েছি।

সুনীল, শীর্ষেন্দু, অতীন, বরেন, আবুল বাশার এদের লেখা পড়েছি কত। তপন রায় চৌধুরীর বাঙাালনামা, মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষ, সুনীলের অর্ধেক জীবন, অতীনের নীল কন্ঠ পাখির খোঁজে আজও দেশ বিভাগের কান্নার রোদন শুনায়।

নূর জাহান বোসের ” আগুনমুখার মেয়ে” এই বঙ্গের একটি মুসলিম মেয়ের সংগ্রাম মুখর জীবন আপনাকে বিস্মিত করবে, আমাকে করেছে যেমন। আমার বাসা ভর্তি বই আর বই। বিচিত্র কালেকশন। কমপক্ষে ৩০০০ তো হবে। ১০ আলমারি ভরা। দুঃখ, এইগুলো আমার ছেলেমেয়েরা পড়ে না। মেয়ে ২/১ টা পড়লেও ছেলে ছুঁয়েও দেখে না।

তাকে চোখের বালি বইটি পড়তে দেই। এ পলক দেখে বলে, এত বড় বই কে পড়ে, পড়া কি সম্ভব? বড়জোর ১ম পৃষ্টা পড়া যায়, আর শেষ পৃষ্টা। মাঝখানের আজরাইয়া প্যাচাল কে পড়ে সময় নষ্ট করে? ওরা রবীন্দ্র নজরুল সঙ্গীত শুনে না। শুনে পপ রক। কি মজা পায় ওরাই জানে!আমার বইগুলো ভাবছি কোনো লাইব্রেরিতে দান করে দেব।

আর একটা কথা, তখন টাকা ছিল না। অনেক পছন্দের বই কিনতে পারিনি, কিন্তু ইচ্ছারা অদম্য। প্রেমিকের মত প্রিয় বইটিকে নিজের করে পাইতে চায়। তাই ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে পছন্দসই কতক বই চুরি করেছি। আর ফেরত দেইনি।

আজ মনে পড়লেও কোনো অপরাধ বোধ জাগে না।”ন চোর হরম ন রাজ হরমন চ ভ্রাত ভাজ্যম…”মহাজ্ঞানী চাণক্য পন্ডিত বলছেন, বিদ্যা চোরে নিতে পারে না, রাজায় কেড়ে নিতে পারে না, ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগ পায় না।কিন্তু আমি বিদ্যা চুরি করেছিলাম একদা!

ভানুলাল দাস

Categories: খোলা বাতায়ন

Leave A Reply

Your email address will not be published.