শুক্রবার ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ শুক্রবার

মির্জা কাদেরের ‘ভোকাল টনিক’

অনলাইন ডেস্ক : রাজনীতিটা এখন ‘কাদের’ নিয়ন্ত্রণে তার কিছুটা বলেছেন নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কাদের মির্জা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই কাদের মির্জা বসুরহাট পৌরসভার মেয়র ছিলেন এবং এবার আবার নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর তিনি বলেছেন, ‘অপরাজনীতির’ বিরুদ্ধে তিনি আগের মতোই কথা বলে যাবেন।

নির্বাচনি প্রচারকালে নানা মুখরোচক কথা বলে মির্জা কাদের ইতোমধ্যে মানুষের নজর কেড়েছেন। তিনি তার নিজের জেলা, বৃহত্তর নোয়াখালী এবং অন্যান্য এলাকার কিছু রাজনীতিককে নিয়ে কথা বলেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরী, নোয়াখালীর একরাম চৌধুরী, ফেনীর নিজাম হাজারী। নিক্সন চৌধুরী সম্প্রতি গঠিত কেন্দ্রীয় যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীতে সদস্যপদ পেয়েছেন। তিনি বসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জার পাল্টা সমালোচনাও করেছেন। সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানও। কাদের মির্জাকে পাগল বলেছেন নিক্সন চৌধুরী। আর সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, তিনি যে ধরনের অভিযোগ করেছেন তা সত্য নয়। যদি আব্দুল কাদের মির্জার কোনও অভিযোগ থাকে তা দলের ফোরামেই বলা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনীতিক যেভাবে কথা বলেন তার মধ্যে কোনও আকর্ষণ থাকে না। একই কথা বারবার বলেন, সে কথায় কোনও প্রাণ থাকে না। সে বিবেচনায় নিজেকে একদম আলাদা করে ফেললেন আবদুল কাদের মির্জা। কথার মধ্যে তথ্য আছে, প্রাণ আছে, নাটকীয়তা আছে, যা মানুষকে এখনও বোরিং করছে না।

এ মুহূর্তে কাদের মির্জার মুখচ্ছবি গোটা দেশে পরিচিত, তার মুখনিঃসৃত বচন সারাদেশে আলোচিত। বলতে গেলে তিনি এখন একাই তার দলের ভাবমূর্তি, তার দলের এজেন্ডা। এই ম্যাজিক তৈরি করেছেন, কারণ অভিযোগ আছে এমন সব ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করতে তিনি দ্বিধা করেননি। তিনি সবই বলেছেন। দলকে ব্যবহার করে কারা কী অন্যায়, অনিয়ম আর সহিংস আচরণ করছেন তার ঝাঁপি তিনি খুলে দিয়েছেন। আর এতেই উল্লাসে মাতোয়ারা দলের বঞ্চিত নেতাকর্মী, পত্রিকা আর অনলাইনের পাতা এবং টেলিভিশন টকশো।

বোঝা যাচ্ছে কাদের মির্জার এই ভোকাল টনিক এক প্রকার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কেউ হয়তো বলবেন যে তিনি নিজে সরকারি দল করেন এবং দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাই বলেই এমনটা বলতে পেরেছেন। অন্য কারও পক্ষে এমন সাহস দেখানো সম্ভব না। অনেকেই বলবেন, আওয়ামী লীগের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা আছে বলেই একজন প্রান্তিক নেতা এমনটা বলতে পেরেছেন। আবার এটাও বলা যেতে পারে, দলের নাম ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠী এতই দুর্বিনীত আচরণ করছে যে, খোদ দলের ভেতর থেকেই এখন কথা বলা শুরু হয়েছে।

দলের ভেতরে থেকে দলের সমালোচনা করার জায়গা অবশ্যই পার্টি ফোরাম। কিন্তু অনেকের পক্ষেই, বিশেষ করে প্রান্তিক নেতাদের জন্য সেই সুযোগ সহজে আসে না। প্রান্তিক নেতাদের অনেকেই এর আগে কথা বলেছেন, তাদের কথাও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু আবদুল কাদের মির্জার কথা আলাদা ধরনের। তার বলার ধরন নাটকীয় এবং তিনি সোজাসুজি রাজনৈতিক ভাষায় প্রকাশ্য জনসভায় এমন সব কথা বলেছেন, যেন মানুষ আলোচনার রসদ পায়। সবার ভাণ্ডারে এমন রসদ থাকে না এবং থাকলেও উপস্থাপন করতে পারেন না।

আমাদের রাজনীতি হলো নিজের কৃতিত্বগুলো বেশি বেশি বলা আর অন্য দলকে নিয়ে হাসিঠাট্টা, রঙ্গরসিকতা করা কিংবা হুমকি দেওয়া। আবদুল কাদের মির্জাও রসিকতা ঢংয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু তা অসার রসিকতা নয়। দলকে আর দেশকে ভাবতে হবে এমন সব কথাই বলেছেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের লড়াই যেমন চলে, তেমনি লড়াই চলে দলের ভেতরেও। কিন্তু সেটা আসলে নীতির সঙ্গে নীতির লড়াই। নীতির প্রশ্নে মতবিরোধ, বিতণ্ডা, সংঘাত এমন জায়গায় পৌঁছে যে, নিজ দলের নেতাকেই নৃশংসভাবে খুন করা যায়? কিংবা শাসক দল করলে সুযোগ আসে বিত্তবান হওয়ার। কিন্তু সেটা কতটা নগ্ন হতে পারে? আবদুল কাদের মির্জা সেটাই বলতে চেয়েছেন।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে আমরা দেখলাম ভোটের প্রচারের সময় দলীয় কর্মীকে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হতে হয়েছে। এমনকি ফল ঘোষণার পরপরই নির্বাচিত কাউন্সিলর খুন হয়েছেন। শাসক দলের অনেকের বিরুদ্ধেই পাহাড়সম দুর্নীতির অভিযোগ। এ অবস্থায় আমরা কি করে গণতন্ত্রের পথে চলবো সেটাই বড় প্রশ্ন।

বহুকাল আগে শুরু হওয়া রাজনৈতিক হিংসার পরম্পরা আজও অব্যাহত। খুনের রাজনীতি বিভিন্ন জনপদের মাটিকে রক্তে রাঙিয়ে দিচ্ছে বারবার। আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্যকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। খুন, সন্ত্রাসকে স্বাভাবিক বিবাদ বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাম দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার দিন ফুরিয়েছে। ফেনীর একরাম হত্যা বা নরসিংদীর লোকমান হত্যার মতো প্রতিটি ঘটনার উদ্দেশ্য বিধেয় সবই পরিষ্কার। এরকম ঘৃণ্য রাজনীতি যারা করছে তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া প্রয়োজন।

এ লেখা যখন লিখছি তখন পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে যে চট্টগ্রামে ছয় কাউন্সিল প্রার্থী খুনের আসামি। এগুলো আগেও হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। ক্ষমতা ও অর্থের লোভে, জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় যারা এসব সমাজবিরোধীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেন ও পার করে নিয়ে আসেন, তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। এ ধরনের নেতারা আধিপত্য বিস্তারের জন্য যেকোনও সীমা লঙ্ঘন করতে পারে। সব এলাকায় সমাজবিরোধীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের লক্ষ্য একটাই, এলাকা দখল ও তার মাধ্যমে নিজেদের গদি টিকিয়ে রাখা। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে দলকে ভাবতে হবে। মানুষের কথা না ভাবলেও দলের কথা ভাবলেও এ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে।

দুর্নীতির মাঝে বিচরণ করে আর লাশের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার অভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার কথাই কি বললেন মির্জা কাদের?

বিষের বাঁশী / ডেস্ক /ব্রিজ

Categories: রাজনীতি

Leave A Reply

Your email address will not be published.