শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

কোরআন অবমাননার ঘটনাটি আসলে গুজব: গোয়েন্দা প্রতিবেদন

অনলাইন ডেস্ক:- লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে কোরআন অবমাননার গুজব রটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মো. শহীদুন্নবী জুয়েলকে গণপিটুনি দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে এ ঘটনাকে বীভৎস ও মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। জুয়েলের বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে মসজিদের খাদেম, ডেকোরেটর মালিক ও ইউপি সদস্যকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসি কোনোভাবেই এ ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে মোটরসাইকেলে এক বন্ধুকে নিয়ে বের হন জুয়েল। এরপর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরের সবচেয়ে বড় মসজিদে বন্ধুকে নিয়ে আসরের নামাজ আদায় করেন। মানসিক ভারসাম্যহীন জুয়েল মসজিদের খাদেম জাবেদ আলীকে বলেন, মসজিদের সেলফে অস্ত্র আছে, আমি চেক করবো। এরপর সেলফে থাকা কোরআন ও হাদিসের বই দেখতে থাকেন। এ সময় জুয়েল অসংলগ্ন কথাবার্তা বলায় খাদেম জাবেদ আলী মসজিদের পাশে থাকা ডেকোরেটর দোকানের মালিক হোসেন আলীকে ডেকে আনেন। মসজিদের খাদেমের কথা শুনে হোসেন আলী জুয়েলকে মারধর শুরু করেন। এরপর তাদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়।

এদিকে, জাবেদ আলী ও ডেকোরেটর দোকানদার প্রচার করতে থাকেন তারা পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছেন। মুহূর্তের মধ্যে একথা ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম জুয়েলের শার্টের কলার ধরে মারতে মারতে জাবেদ আলী ও হোসেন আলীকে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে যান এবং সেখানেও মারধর করেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা জুয়েল ও তার সঙ্গীকে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে বুড়িমারীতে অবস্থানরত পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন্নাহার বেগম এবং পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন কুমার মোহন্ত ঘটনাস্থলে গিয়ে জুয়েল ও তার বন্ধুকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তারা বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েন। পরে ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান জুয়েলের বন্ধুকে নিয়ে বুড়িমারী স্থলবন্দরে ন্যাশনাল ব্যাংকে আশ্রয় নেন।

অন্যদিকে, ইউনিয়ন পরিষদের কলাপসিবল গেট ও দরজা ভেঙে শত শত জনতা জুয়েলকে বের করে গণপিটুনি দিতে দিতে বাইরে নিয়ে আসে। একপর্যায়ে তার মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেই উত্তপ্ত আগুনে জুয়েলকে নিক্ষেপ করে। ফলে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে দগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এরপরও বিক্ষুব্ধ জনতা তার পুরো শরীর জ্বলে অঙ্গার না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। এর মধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে এসে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে, জনতার ধাওয়া খেয়ে পুলিশ সদস্যরা ও ওসি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আহত হন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। প্রায় দুই ঘণ্টার আগুনে জুয়েলের শরীর ভস্মীভূত হয়। পরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও ততক্ষণে জুয়েলের ২-৩টি হাড় ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, একজন নিরপরাধ মানুষকে এভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে লাশ পর্যন্ত ভস্মীভূত করার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। তদন্তে জুয়েলের কোরআন অবমাননার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। তার কথা অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই। এরপরও কেন তিনি জুয়েলকে রক্ষা করতে পারলেন না, এটা দুঃখজনক।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নিহত জুয়েলের বাবা ওয়াজেদ আলী ও উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুলের শ্বশুর প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি আবেদ আলী ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এছাড়া নিহত জুয়েলের বড় বোন হাসনা আখতার লিপির স্বামী কালীগঞ্জ উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান উপজেলা চেয়াম্যানের আত্মীয় বলেও গোয়েন্দারা তদন্তে জানতে পেরেছেন। নিহত জুয়েল এর আগেও অনেকবার কালীগঞ্জে বড় বোনের বাড়িতে এসেছেন, সেখান থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখাও করেছেন। ফলে জুয়েল যে মানসিক ভারসাম্যহীন সে বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যানও জানতেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। তবে জুয়েলকে মারধরের সময় তিনি এ কথা কাউকে বোঝাতে পারেননি। আবার জুয়েলকেই তখন মারধর করা হচ্ছে এটাও তিনি জানতেন কিনা সে বিষয়টিও প্রমাণসাপেক্ষ।

এ ঘটনায় আজ শনিবার তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে নিহত জুয়েলের পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা, ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় চেয়ারম্যানের দায়ের করা ভাঙচুরের মামলা এবং পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা আরেকটি মামলা। এসব মামলায় অন্তত ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ওই এলাকার  ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

বিষেরবাঁশী.কম/ডেস্ক/রূপা

Categories: অপরাধ ও দুর্নীতি,সারাদেশ

Leave A Reply

Your email address will not be published.