বৃহস্পতিবার ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ ২৮ মার্চ, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

এভাবে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপাদনের অনুমোদন নেই

অনলাইন ডেস্ক: মর্মান্তিক। বীভৎস। কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। কারও চেহারা ঝলছে গেছে। ছোপ ছোপ কালচে তাজা রক্ত রাস্তায় গড়াচ্ছে। আনুমানিক ৬-১৪ বছর বয়সী ১০-১২ জন ক্ষুদে শিশু মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। সেকেন্ডের মধ্যে অসহায় পিতা নূরু ইসলাম দেখেন তার ১১ বছর বয়সের শিশু সন্তান রুবেলের ছিন্নভিন্ন দেহ একটু দূরে পড়ে আছে। রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পূর্ব কোণায় শিয়ালবাড়ি বস্তির সামনে এ ঘটনা ঘটে। গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) বিকাল পৌণে ৪ টার দিকে বেলুন ফুলানোর হাইড্রোজেন গ্যাস রি-এ্যাক্টর বিস্ফোরিত হলে এ ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। একটি রিকশা ভ্যানে করে গ্যাস বেলুন বিক্রি করা হচ্ছিল। সখের বেলুন কিনতে রিকশা ভ্যানটিকে ঘিরে ধরেছিল প্রায় ২০ জন শিশু। বেলুন ওয়ালার চারদিক ঘিরে শিশুদের আনন্দ হৈ হুল্লোড়। গ্যাস দিয়ে ফুলানো রঙ্গিন বেলুন উড়ে যাচ্ছিল আর বেলুনটির সুতা শিশুর হাতে বাঁধা ছিল। রিকশা ভ্যানটিতে হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ। মুর্হূতে আনন্দ হুল্লোড় মৃত চিৎকারে পরিণত হয়। চারদিকে ছড়িয়ে ছিন্নভিন্ন রঙ্গিন বেলুন আর শিশুদের রক্তাক্ত দেহ। বিস্ফোরণে লন্ডভন্ড হয়ে যায় ৫ শিশুর পরিবারের বাবা-মায়ের স্বপ্ন। এ ঘটনায় আরো ১৭ জন শিশুসহ ২০ জন আহত হয়। নিহতরা হলেন রুবেল (১১), রমজান (৮), শাহীন (৯), নুপুর (৯) ও ফারজানা (৬)। তবে গ্যাস বেলুন বিক্রেতার পরিচয় পাওয়া যায়নি। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুয়েল (৩০) ও সোহেল (২৫) নিজেদেরকে রিকশাচালক বলে দাবি করেছেন। শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয় : বিস্ফোরণের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সড়কের বাসিন্দা সোহাগ নামে এক তরুন। তিনি বলেন, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ অনেক জোরে একটা শব্দ শুনে জেগে উঠি। ভাবছিলাম বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়েছে। দেখি আমার ঘর কাঁপছে। পরে বাইরে বের হয়ে দেখি-বাচ্চাদের ছিন্নভিন্ন দেহের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। কেউ মরা, কেউ জীবিত, কেউ গোংগাচ্ছে। রাস্তায় রক্ত আর মাংস ছিটিয়ে রয়েছে। চারদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আমি নিজেই তিনজনকে উদ্ধার করে রূপনগর সুরক্ষা হাসপাতালে নিয়ে যাই। যারা মারা গেছে তারা সবাই ১১ নম্বর রোডের বস্তির শিশু সন্তান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে চিৎকার করে কাঁদছিলেন নূর ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি একজন রিকশাচালক। তার চোখের সামনে ১১ বছরের শিশু রুবেল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘ওরে রিকশা ভ্যানের কাছে রাইখা সামনে আগাইয়া গেছি। ও বেলুন কিনবার চাইছিল। একটু আগায়া যাইতে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ। কালো ধোঁয়ার মধ্যে দেখি ১০/১২ টা বাচ্চা ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়ে।’ তিনি আরো বলেন, তার বাড়ি ভোলায়। ১১ নম্বর রোডের শেষ মাথায় টিনশেড বস্তিতে তিনি থাকেন। রুবেলকে কয়েকদিন আগে ভোলা থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। ইচ্ছা ছিল স্কুলে ভর্তি করার। কিন্তু তার এ স্বপ্ন হাইড্রোজেন গ্যাস রি-এ্যাক্টরের বিস্ফোরণের কাছে পরাজিত হয়ে গেলো। রূপনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক কুমার দাস বলেন, ঘটনাস্থলের পাশে শিয়ালবাড়ি বস্তি। একারণে সেখানে শিশুরা ছিল বেশি। তারা সেখানে খেলছিল। গ্যাস বেলুন বিক্রির রিকশা ভ্যানগাড়ি দেখে তারা সেখানে ছুটে যায়। তিনি বলেন, নিহত শিশুদের লাশ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পরপর জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে ফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট গিয়ে উদ্ধার কাজ চালায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৫ শিশুর লাশ উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে ৫/৬ টি অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে ৪ জনকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেহা (৮), অর্ণব (১০), জনি (৯), মোরসালিনা (৮), মীম (৮), সিয়াম (১১), অজ্ঞাত (৫), মোস্তাকিন (৮), উজুফা (৭), তানিয়া (৭), জামিলা (৮), বায়েজিদ (৮), সোহেল (২৫), জান্নাত (২৬) জুয়েল (২৯) ও রাকিব (১২) ভর্তি রয়েছে। এদের মধ্যে গৃহকর্মী জান্নাতের এক হাত উড়ে গেছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া জানান, এক নারী ও তিন শিশুসহ চারজনকে মৃত অবস্থায় এই হাসপাতালে আনা হয়। আহতদের মধ্যে চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিস্ফোরণে নিহতদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়। এ চারজনের দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। যে দুজন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন তারা বিপদমুক্ত। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়াতে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। অবৈধ হাইড্রোজেন গ্যাস রি-এ্যাক্টর বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামছুল আলম গতকাল বলেন, এটা হাইড্রোজেন গ্যাস রি-এ্যাক্টরের বিস্ফোরণ। এভাবে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরির কোন অনুমোদন নেই। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এর আগে আইন-্শৃটাঙ্খলা বাহিনীর কাছে বহুবার চিঠি দেয়া হয়েছে। এরপরও কেউ ব্যবস্থা নেয় না। যখন দু-একটি দুর্ঘটনা ঘটে, তখন কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। রাস্তায় যে কেউ এভাবে বেলুনে গ্যাস ভরিয়ে বিক্রি করতে দেখলে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে খবর দেয়া উচিত। যেভাবে তৈরি হয় হাইড্রোজেন রি-এ্যাক্টর একটি কাঁচের পাত্র বা লোহার সিলিন্ডারে কস্টিক সোডা মিশ্রিত পানির দ্রবণ ভরানো হয়। দ্রবনে এ্যানোড ও ক্যাথোড দন্ড দিয়ে পাত্র বা সিলিন্ডারের মুখ ছিপি দিয়ে আটকে দেয়া হয়। এরপর ব্যাটারির সাহায্যে এ্যানোড ও ক্যাথোডের মধ্যে বিদ্যুত প্রবাহ করা হলে দ্রবন থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। পাত্র বা সিলিন্ডারের ছিপিতে সংযুক্ত নল দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাস বেলুনে ভরিয়ে বিক্রি করা হয়। অনেক সময় বিদ্যুত প্রবাহের সময় দ্রবনে বিক্রিয়ার মাত্রা বেড়ে গেলে তা দ্রুত বিস্ফোরিত হয়। বিষেরবাঁশি.কম/ডেস্ক/মৌ দাস/আহসান শিপু

Categories: অপরাধ ও দুর্নীতি,সারাদেশ

Leave A Reply

Your email address will not be published.