বৃহস্পতিবার ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ ২৮ মার্চ, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

দলীয় প্রার্থীর নাম জানাতেও কৌশলী আ.লীগ-বিএনপি

বিষেরবাঁশী ডেস্ক: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ২৩০ আসনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন চিঠি দেয় গত রোববার। পর দিন অর্থাৎ গত সোমবার বাকি ৭০ আসনসহ সংসদীয় ৩০০ আসনে একযোগে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম প্রকাশ করার কথা। কিন্তু পর দিন কৌশলগত কারণে নাম ঘোষণা থেকে বিরত থাকে দলটি। প্রার্থীর ব্যাপারে বিএনপির কৌশল দেখে জোটগত প্রার্থী চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

একইভাবে বেশির ভাগ আসনে একাধিক প্রার্থী রেখে প্রথমে গত সোমবার, পরে গতকাল দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দেয় বিএনপি। এর পরপরই অবশিষ্ট আসনগুলোতে ২০ দলীয় জোট ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ ৩০০ আসনেই চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করার কথা দলের। কিন্তু এখন বলছে, ৯ ডিসেম্বরের আগে অর্থাৎ মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষদিনের আগে পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে না। ফলে এবার নির্বাচনে সংসদীয় ৩০০ আসনে শেষ পর্যন্ত কে হচ্ছেন নৌকা ও ধানের শীষের চূড়ান্ত প্রার্থী তা জানতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে প্রার্থী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে এই অপেক্ষায় সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন দুই দলের জোটের শরিক ও মিত্র দলগুলো। কারণ চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগে এসব দল ঠিক কতটি আসন পেল এবং কোন আসনে কাকে প্রার্থী করা হলো তা জানতে পারছে না কেউ।

দুই দলের প্রার্থী তালিকা হঠাৎ করেই থেমে যাওয়ায় মনোনয়ন ঘিরে যে উৎসবের আমেজ দেখা দিয়েছিল গোটা দেশে, তা কিছুটা হলেও রং হারিয়েছে। এখনো জোটের সঙ্গে আসন সমঝোতা না হওয়ায় মনোনয়ন চিঠি পাওয়া দুই দলের দলীয় প্রার্থীরাও কমবেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কি হয় শেষ পর্যন্ত, জোটের চাপে নিশ্চিত আসনটিও হাতছাড়া হয় কিনা—এমনতর নানা আশঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছে প্রার্থীদের মনে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যেসব আসনে দুজন প্রার্থী রেখেছে এবং বিএনপি একাধিক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে, এই প্রার্থীরা রয়েছে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে। শেষ অবধি দল কি সিদ্ধান্ত নেয় সেদিকে তাকিয়ে সবাই।

শুধু প্রার্থিতা হাতছাড়ায় নয়; আসন নিয়ে সুষ্ঠু সমাধানের প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে এই দুই দলের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সবার নজর সেদিকে। আলোচনা হচ্ছে তা নিয়েও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে বিএনপি। দলীয় প্রার্থীদের পাশাপাশি এই দলকে সামাল দিতে হচ্ছে শরিক ২৩ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চার দল মিলে মোট ২৭ দলকে। এখন আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে শরিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক মাঠের সেই ঐক্য কতটা অটুট থাকে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তা নিয়ে। কেননা আসন ভাগাভাগি ছাড়াই ঐক্যফ্রন্টের দলগুলো আলাদা আলাদাভাবে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছে। এমনকি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যকে ৯টি আসন দেওয়া হলেও ওই সব আসনে বিএনপির অনেক নেতাকেও মনোনয়নপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাাপারে জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ধানের শীষের প্রতীক বরাদ্দের চিঠি দেওয়ার সময় জানা যাবে ধানের শীষের প্রার্থী কারা। অর্থাৎ আগামী ৯ ডিসেম্বর বা এর কাছাকাছি সময়ই মূলত প্রার্থী চূড়ান্ত করবে ঐক্যফ্রন্ট। অবশ্য এরই মধ্যে এই জোটের সব দলই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আওয়ামী লীগকেও একই সমস্যা পোহাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক নেতারা। তাদের মতে, ১৪ দলের শরিকদের মানানো গেলেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার সমাধান হচ্ছে না। এই দলটি যতগুলো আসন দাবি করছে তা দিতে হলে আওয়ামী লীগের অনেক দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন হারাতে হবে। আবার ওইসব আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করে কি না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। অন্যদিকে আসন সমঝোতা না হলে পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ হঠাৎ করেই কি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন তা নিয়েও উদ্বিগ্ন ক্ষমতাসীনরা।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা সবকিছু বিবেচনা করে, প্রতিপক্ষের প্রার্থী বুঝে দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করব। জোটের শরিকদের সঙ্গেও যেন কোনো ধরনের মনোমালিন্য না হয় সেটাও দেখতে হবে। যদিও দুই দল বলছে, প্রতিপক্ষের প্রার্থী দেখে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে তারা। কিন্তু দল দুটির দলীয় সূত্র মতে এই কারণের পাশাপাশি জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। দলের নীতিনির্ধারকরা জানান, দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত। তা প্রকাশও করা হয়েছে। কিন্তু জোটের সঙ্গে এখনো আসন নিয়ে সমঝোতা হয়নি। ফলে দলীয় প্রার্থীর তালিকাও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা যাচ্ছে না।

বিএনপির প্রার্র্থীর নাম দেখে আওয়ামী লীগের তালিকা প্রকাশ : প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রার্থীদের নাম দেখে দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ। এরপর প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ। দলের নেতারা প্রকাশ্যে এটাকে নির্বাচনী ‘কৌশল’ বলে দাবি করলেও নেপথ্যে জোটের শরিক ও মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আসন নিয়ে সমঝোতা না হওয়া এই দেরির অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। দলীয় সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ জোটের শরিক ও মিত্রদের যে সংখ্যক আসন ছাড় দিতে চায় তাতে কেউ সন্তুষ্ট হতে পারছে না। গতকাল পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো সমঝোতাও হয়নি। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিএনপির মতো আওয়ামী লীগও চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা তৈরি ও প্রকাশে বিশেষ কৌশল নিয়েছে। গত সোমবার একযোগে ৩০০ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার কথা থাকলেও তা থেকে পিছিয়ে এসেছে দলটি। এখন দলের নেতারা বলছেন, বিএনপির প্রার্থী দেখে দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। এ ব্যাপারে গত সোমবার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, জোট ও মহাজোটগত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ টেকনিক্যাল কিছু কারণে পরিবর্তন এনেছে দল। সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে যাচাই-বাছাই শেষে জোট ও মহাজোটগতভাবে তালিকা প্রকাশ করা হবে। জোটের অন্যান্য শরিকরা তাদের নিজ তালিকা প্রকাশ করবে।

ওবায়দুল কাদের এমনও জানান, কিছু আসনে দুজন প্রার্থীকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা জমা দেবেন। সেগুলো মাঠ পর্যায়ে আরেকবার সার্ভে করা হবে কে বেশি জনপ্রিয়। আবার কেউ কেউ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের পর অযোগ্য ঘোষিত হতে পারে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করে জোট শরিকদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। তবে ওবায়দুল কাদের ‘প্রতিপক্ষ’ অর্থাৎ বিএনপির কৌশল দেখে প্রার্থী দিতে চান বলেও জানান। তিনি বলেন, আমরা কৌশলে মার খেতে চাই না। কৌশলেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

তবে দলের সূত্রগুলো এই দেরির নেপথ্যে কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছে। সূত্র মতে, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে কিছু প্রভাবশালী নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিতে পারেন। সুতরাং তাদের কথাও ভাবা হচ্ছে। এছাড়া ভোটের মাঠের প্রতিপক্ষকে আগেভাগেই দলীয় প্রার্থীর নাম জানানো হবে না। মহাজোটের মনোনয়নবঞ্চিতরা যেন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে প্রার্থী হতে না পারে সেদিকটাও নজরে রাখা হচ্ছে। এতে বিদ্রোহী প্রার্র্থী দমন সহজ হবে। এমনকি শেষ মুহূর্তে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন থেকে সরে গেলে বা বিএনপির সঙ্গে মনোমালিন্য হলে যাতে প্রার্থিতায় পরিবর্তন আনা যায় সেটাও একটা কৌশল।

প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে বিএনপির চূড়ান্ত তালিকা : দলের সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চাপের কারণে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করলেও প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করতে পারছে না বিএনপি। ঐক্যফ্রন্ট চাচ্ছে আসনের ব্যাপারে সমঝোতা করে একযোগে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা। এজন্য গত সোমবার শতাধিক আসনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন চিঠি দিলেও গতকাল এই সংখ্যা ছিল অনেক কম। এমনকি দলটি এখন বলছে, নির্বাচন কমিশনের প্রতীক বরাদ্দের পর ওই চিঠিসহ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীদের নাম জানাবে তারা। অর্থাৎ ৩০০ আসনে কে হবেন ধানের শীষের প্রার্থী, তা জানতে প্রার্থী, সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের অপেক্ষা করতে হবে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কারণ ওইদিন প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন।

বিএনপির দলীয় সূত্র বলছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা হচ্ছে না। গতকালও বৈঠক হয়েছে। আসন নিয়ে এক ধরনের আলোচনা হলেও ঠিক সমঝোতা হয়নি। এছাড়া ক্ষমতাসীনরা এখনো ৩০০ আসনে প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি। এ কারণে প্রার্থীদের নাম প্রত্যাহারের আগে পর্যন্ত বিএনপি প্রার্থীদের নাম গোপন রাখার চেষ্টা করছে।

সূত্রগুলো আরো জানায়, সারা দেশে বিএনপির অনেক নেতার নামে মামলা আছে। অনেকে ‘মিথ্যা’ মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ কারণে বিভিন্ন আসনে একাধিক প্রার্থীর নাম রাখা হয়েছে। একজন বাদ পড়লে যেন ওই আসনে দ্বিতীয়জন কিংবা তৃতীয়জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এমনকি কোনো কোনো আসনে নেতাদের পাশাপাশি তাদের স্ত্রীদের নামও রাখা হচ্ছে। এবার বিএনপি কোনোভাবে ভোটের মাঠ ছাড়বে না, যে কারণে মনোনয়নের চিঠি নিয়েও একটু বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, প্রতীক বরাদ্দের আগে পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থীদের নাম জানানো হবে না। প্রতীকের চিঠি পাঠিয়ে তালিকা প্রকাশ করা হবে। এখনো সময় আছে। তাই কোনো অসুবিধা হবে না।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/ইলিয়াছ

Categories: রাজনীতি

Leave A Reply

Your email address will not be published.