বৃহস্পতিবার ৫ বৈশাখ, ১৪৩১ ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

রাজধানীর অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে

বিষেরবাঁশী ডেস্ক: ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে এক হাজার ৬৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে ৪৩টি হত্যাকান্ড। এসব ঘটনার মূলে রয়েছে- অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদার ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, জমি দখলবাজিসহ স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার।

আর চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে শুধু রাজধানীতে ১৮৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ঝুট ব্যবসা, ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে ১৪টি হত্যাকাণ্ড। বাকিগুলো পারিবারিক কলহ, ছিনতাইসহ অন্যান্য ঘটনা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দাবি, রাজধানীর অপরাধ পরিস্থিত তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। শুধু আধিপত্য বিস্তারের জেরে সংঘটিত হত্যাকান্ড নয়, দায়ের করা প্রতিটি মামলাই ডিটেকশন করা হয়। এজন্য বড় ধরনের এসব হত্যাকান্ড রাজধানীতে ঘটার সুযোগ বর্তমানে অনেকাংশে কম। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালের চেয়ে পরের বছরগুলোতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পর্যায়ক্রমে কমেছে।

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে ঝুট ব্যবসার দ্বন্দ্বের কারণে মিরপুরে খুন হন মহিউদ্দিন মোহন। গত ৯ নভেম্বর রাতে মিরপুরে সেকশন-১০ এর প্যারিস রোডে তাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন নিহতের স্ত্রী। মামলার এক আসামি গ্রেফতার হলেও হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত কাউকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তারা বলছেন, ঝুট ব্যবসায়ী মোহন হত্যার ঘটনায় এক আসামি গ্রেফতার আছে। বাকিদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। মূলত মিরপুর পল্লবী এলাকায় ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের জেরেই মোহন নিহত হন। এর আগেও ঝুট ব্যবসায়ী মোহনের ওপর হামলা হয়েছিল, সেই মামলায় দুই আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন।

মিরপুরের ঝুট ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন মোহনের স্ত্রী তামান্না জানান, ঝুট ব্যবসা করার কারণে প্রায়ই মোহনের পূর্ব পরিচিত ব্যবসায়িক অংশীদার দীলিপ ও তার সহযোগীরা বিভিন্নভাবে হুমকি দিত। ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বলত। তাই তিন বছর আগেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিল মোহন। এরপর আজমত গার্মেন্টের মালিকের পরামর্শে আবারও ঝুট ব্যবসা শুরু করেন। এজন্য দীলিপ ও তার সহযোগীরা তাকে মেরে ফেলতে গুলি করেছিল। সেই ঘটনায় মামলা করা হয়েছিল। মামলা তুলে নিতে বারবার হুমকি আসত। মূলত এই কারণেই পরিকল্পিতভাবে দীলিপ ও তার সহযোগীরা মোহনকে গুলি করে হত্যা করে।

শুধু মোহনই নয়, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট বাড্ডায় ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা শামসু মোল্লাসহ চারজন খুন হন। একই বছরের ৩ মে বাড্ডা জাগরণী সংসদ ক্লাবে গুলি করে হত্যা করা হয় থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রায়হানকে। একই বছরের ১০ আগস্ট কাফরুলের সৈনিক লীগ নেতা রুবেল হোসেনকে হত্যা করা হয়। মিরপুর, কাফরুল, পল্লবী এলাকার গার্মেন্ট ঝুট ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরে এ ঘটনা ঘটে।

পুলিশ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ৪৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনার মূলে রয়েছে— অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, জমির দখলবাজিসহ স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার।

ডিএমপির দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে এক হাজার ৬৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ২৬২টি, ২০১৫ সালে ২৩৯টি, ২০১৬ সালে ১৬৫টি, ২০১৭ সালে ঘটে ২১৮টি হত্যাকাণ্ড। আর ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৮৪টি। ২০১৪ সালে রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডে ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে হত্যাকাণ্ড তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে। তবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চলতি বছরে ১৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যা আশঙ্কাজনক। তবে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মাহবুব আলম জানান, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে ৪৩টি হত্যাকাণ্ড এটি খুব বেশি নয়। কারণ রাজধানীর অপরাধ পরিস্থিত আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।

আধিপত্য বিস্তারে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড :

রাজধানীতে আধিপত্য বিস্তার, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ডিশ বা ক্যাবল ব্যবসা ও দখলবাজির কারণেও ঘটেছে হত্যাকাণ্ড। ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মেরুল বাড্ডার মাছের আড়তে ঢুকে রবিন গ্রুপের নির্দেশনায় আবুল বাশার নামে আরেক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই বছরের ২২ এপ্রিল বাড্ডার বেরাইদ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের জাহাঙ্গীর আলমের ছোট ভাই কামরুজ্জামান দুখু প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন। এরপরের মাসে বাড্ডা জাগরণী ক্লাবের ভেতর ঢুকে সস্ত্রাসীরা ডিশ ব্যবসায়ী বাবুকে গুলি করে হত্যা করে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আদাবরে খুন হন ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতা মশিউর রহমান মশু। একই বছরের ৯ আগস্ট মোহাম্মদপুরে খুন হন স্থানীয় যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিন।

২০১৭ সালের ১ এপ্রিল গেন্ডারিয়ায় কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী জাকির হোসেন খুন হন। একই বছর জানুয়ারিতে গুলশানের কালাচাঁদপুরে খুন হন যুবলীগ নেতা মাইনুদ্দীন। ২০১৬ সালের জুলাইতে পুরান ঢাকায় খুন হন রাজিবুল হাসান রাজীব। একই বছরের ২২ জানুয়ারি রামপুরায় খুন হন স্যানিটারি ঠিকাদার বাসাই শিকদার (৩০)। ২০১৫ সালের আগস্টে ওয়ারীতে খুন হন আবদুল মান্নান।

একই বছরের ৮ এপ্রিল খিলগাঁও জোড়পুকুর এলাকার যুবলীগ নেতা আরিফ হোসেন খুন হন। ২০১৪ সালের ৯ আগস্ট পশ্চিম আগারগাঁওয়ে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম। একই বছরের ২৩ জানুয়ারি মগবাজারে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রানাও খুন হন। একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শ্যামপুরে রিয়াজুল ইসলাম লালুকে হত্যা করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার, ক্যাবল ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ওই এলাকা নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল সন্ত্রাসী ডালিম-রবিন গ্রুপ। মালয়েশিয়া পলাতক থেকেই ভাড়াটে খুনি দিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য রাজনৈতিক নেতাসহ অনেককেই খুন করেছে এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। এসব হত্যা মামলার বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন আসামি নিহত হয়েছে। এই কারণে বাড্ডা এলাকায় হত্যাকান্ডের ঘটনা কিছুটা কমে এসেছে।

ডিএমপি গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাজাহান সাজু জানান, রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের কারণে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল সেসব মামলার আসামিদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলার চার্জশিট প্রস্তুতের কাজ চলছে। আর এসব হত্যাকন্ডের নির্দেশদাতারা যারা বিদেশে রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: সারাদেশ

Leave A Reply

Your email address will not be published.