শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

কী বার্তা দিল আওয়ামী লীগ

প্রতীক ইজাজ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে এ বছর দিবসটি এক ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল। দিবসটি উদ্যাপনে তাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত বুধবারে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ হয়ে উঠেছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাবেশ রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে। সমাবেশে একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও তার সংগ্রামী জীবনের অবদান মুছে ফেলতে বিভিন্ন সরকারের নানা অপতৎপরতার তীব্র সমালোচনা হয়েছে; তেমনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী নানা দিকনির্দেশনাও ওঠে এসেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্বাচনকেন্দ্রিক সুস্পষ্ট ভাষণ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়েছে সাধারণ মানুষ ও দলের নেতাকর্মীরা।

বুধবারের ভাষণে অবশ্য শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নতুন করে আর কোনো বক্তব্য রাখেননি। কেননা, এর আগে বিভিন্ন সময় তিনি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে সরকার যে সংবিধানের বাইরে যাচ্ছে না, তা জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। সে ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দাবিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তবে দলের অন্য নেতারা এ নিয়ে কথা বলেছেন।

সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছু বার্তা এসেছে। দলের নেতারা একদিকে যেমন এই সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছেন; তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে বলে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এমনকি তারা বিএনপিকে সংবিধান মেনে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি নির্বাচনে না হলে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তারা। ক্ষমতাসীনরা বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় না আনার আহ্বান যেমন জানিয়েছেন; তেমনি দল দুটি যেন নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বুধবারের সমাবেশটি ঐতিহাসিক রাজনীতি ও বর্তমান নির্বাচনী রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পরোক্ষভাবে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ভোট না দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ভাষণের বড় অংশজুড়ে ছিল উন্নয়নের পথে এগিয়ে আসার আহ্বান। এর মধ্য দিয়ে তিনি বর্তমান সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে জেল হত্যার ঘটনা, পরের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে বিগত সরকারগুলোর নানা অপতৎপরতার রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।

অন্যদিকে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে আবারও আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার সরাসরি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও এবং দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও নির্বাচিত করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

বুধবারের সমাবেশ ঘিরে বেশ উজ্জীবিত আওয়ামী লীগও। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সমাবেশে যে জনসমুদ্র হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে এই সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা প্রমাণ হয়েছে। বিশেষ করে সমাবেশে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। বিএনপির মাঠে নামার চেষ্টার বিপরীতে আওয়ামী লীগ ব্যাপক জনসমাগম করতে পারায় দলের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে বলে দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তাদের মতে, সমাবেশ থেকে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের আওয়ামী লীগের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে। তা ছাড়া জঙ্গিবাদ ইস্যু, সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড, পরিকল্পনা, বিএনপির নেতাদের ‘দুর্নীতি’, বিএনপি চেয়ারপারসনের জেলসহ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিষয়গুলো উঠে আসায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তাদের শরিক জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারেও স্পষ্ট বার্তা গেছে সবার কাছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা এমনও মনে করছেন, এ বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের জন্য হাতে খুব বেশি সময় নেই। নির্বাচন বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা দিকনির্দেশনা পেয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদন্ড, নতুন করে জঙ্গি হামলার বিষয় সামনে আসায় সমাবেশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদন্ড হওয়ার পর থেকে বিএনপি বেশ কিছুদিন থেকে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির মাঠে নামার চেষ্টা এবং খালেদা জিয়া জেলে থাকায় জনগণের সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা যেন দলটি করতে না পারে; সেজন্য আওয়ামী লীগ তাদের সরব উপস্থিতি জানান দিল। এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সবার উদ্দেশে একটি বার্তা দিল, তা হলো-এখনো আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের ‘পছন্দ’ ও ‘আস্থার’ সংগঠন।

এ ব্যাপারে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ৭ মার্চের জনসভা নেতাকর্মীদের জনসভা ছিল না, জনগণের জনসভা ছিল। স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের সমাবেশ ছিল। সমাবেশে তাদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে। অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনার পর নতুন করে জঙ্গি হামলার বিষয়টি সামনে এসেছে। তা ছাড়া এ বছরের শেষেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এসব বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দল এবং দেশবাসীর প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।

সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াত যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও খুনিরা যেন আর কখনো বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসতে না পারে। যারা এতিমের টাকা চুরি করে, যারা আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ায়, যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে, তারা যেন দেশকে আর ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে না পারে। এজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। শেখ হাসিনা আরো বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিÑতারা সতর্ক থাকবেন।

দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সতর্কবার্তা দিয়েছেন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে বলেও পুনঃবার্তা দিয়েছেন তারা। সমাবেশে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলার জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন নিয়ে আবারও শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত করতে হবে। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা এই দেশের মানুষ কোনো দিন সহ্য করেনি। এবারও কোনো ষড়যন্ত্র এই দেশের মানুষ সহ্য করবে না। বিএনপি যদি এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

সমাবেশে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও নির্বাচিত করার ও বিএনপি-জামায়াতকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এজন্য তারা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড ও বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন অপকীর্তি তুলে ধরেন। সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু বলেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যা কিছু অর্জন, সবকিছু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করা সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনার মাধ্যমে বাংলার মানুষ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা পাচ্ছে। তিনি বলেন, তার পরও ষড়যন্ত্র হয়। এই ষড়যন্ত্র নেত্রীর বিরুদ্ধে নয়, এই ষড়যন্ত্র দলের বিরুদ্ধে নয়-এই ষড়যন্ত্র বাংলার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সাহারা খাতুন আগামী নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও দেশের নেতৃত্বে নিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গাড়িতে আগুন দিয়ে যেন কেউ মানুষ হত্যা করতে না পারে, তারা যেন আর ক্ষমতায় আসতে না পারে-সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: খোলা বাতায়ন,রাজনীতি

Leave A Reply

Your email address will not be published.