বৃহস্পতিবার ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ ২৮ মার্চ, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

বারুদ ছড়ানো সেই ভাষণ

ফয়জুন্নেসা মণি: ১৯৭১ সাল। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বিকেল ৩টা ২০ মিনিট। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য অসাধারণ স্মরণীয় দিন। পুরনো সেই রেসকোর্স ময়দান। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সমবেত জনসমুদ্রে প্রতিবাদী বাঙালির গর্জন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু শতাব্দীর পরাধীনতার গ্লানি মোচনে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। পুরো জাতি প্রতীক্ষায়। কখন আসবেন কবি। বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠবে আকাশ-বাতাস। সমবেত গর্জনের হুঙ্কারে থমকে যাবে অত্যাচারীর স্পর্ধা। চারদিকে মুহুর্মহু স্লোগান। ভয়, শঙ্কা দুঃশাসকের রাহুগ্রাসের। অবশেষে কবি এলেন। মঞ্চে উঠলেন। শোধালেন অমর কবিতাখানি। ১৯ মিনিটের এক অলিখিত ভাষণ দিলেন। যেন বাংলার মানুষের বুকের ভেতরের চাপ পড়া কষ্টের কথাগুলোই বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো।

তিনি বললেন ‘…তোমাদের যা কিছু আছে… তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে।… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো…রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব… এই দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ…’। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঈঙ্গিত দিয়ে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। সবার হাতে ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা। কোটি প্রাণের আবেগকে একজন দেশনায়ক কীভাবে তার কণ্ঠে ধারণ করেন ৭ মার্চের ভাষণ তার উজ্জ্বল প্রমাণ।

বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির রূপরেখাও এই ঐতিহাসিক ভাষণেই রয়েছে। সেই ভাষণ আজ মহিমান্বিত মর্যাদার অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ (এমওডব্লিউ) তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এমওডব্লিউতে এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। বিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণগুলোর মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে—বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ভাষণ। তাই ৭ মার্চের ভাষণ এখন বিশ্বের অনন্য দলিল। আর বাংলার মুক্তিসনদ এই ভাষণ।

কী অসাধারণ কাব্যিকব্যঞ্জনা। সাবলীল কথার স্ফুরণ। প্রতিরোধের অকুণ্ঠ উচ্চারণ। শব্দে-বাক্যে, ভাবে-প্রকাশে এ যেন সংক্ষুব্ধতায় বিক্ষোভের এক অনন্য কাব্যময় প্রকাশ। তিনি বলতে লাগলেন—‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সব-ই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ তিনি থামলেন না। ভয় পেলেন না। বরং তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখো জনতার প্রতিক্ষার প্রহর ভেঙে, উত্তেজিত জনতার চেতনার বারুদে মুক্তি সংগ্রামের আগুন ধরিয়ে দিলেন। তবে কি তিনি জানতেন, এই বাঙালি আর থামবে না! তিনি নিপীড়িত বাঙালিদের অভিভাবক হয়ে বলতে লাগলেন—‘২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন—তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম। তারপর, তখন বাঙালির ওপর যে অত্যাচার করা হচ্ছিল, তার কথাও বললেন—কী পেলাম আমরা?’ এ যেন কবিতার বাণী, অমৃত উচ্চারণে বিদ্রোহের উসকানি! এখানে তিনি বুঝিয়ে দিলেন—আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। আর অপেক্ষার কিছু নেই-দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তিনি বৃষ্টিবুলেট তোয়াক্কা না করেই বললেন—‘আমরা জামার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের ওপর চালানো হচ্ছে গুলি। ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট-দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের ওপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ কথায় কত জাদুকরী কৌশল। প্রতিটি উচ্চারণে তিনি ভদ্রতার সম্বোধন করেই অভিযোগের তর্জনী তুলেছেন ইয়াহিয়ার দিকে। তিনি বলেছেন ‘…আমি বলেছি, কিসের বৈঠকে বসব, কার সঙ্গে বসব? যারা মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব?

২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ওই শহীদের রক্তের ওপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’ তারপর তিনি হুঙ্কার ছুড়ে বাঙালির সুপ্ত প্রতিরোধ চেতনাকে উসকে দিয়ে বললেন—‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি—তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ৭ কোটি মানুষেরে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’ এই বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে না পারার রক্ত গরম মানসিকতার কথা জাতির অভিভাবক হিসেবে তিনি হয়তো আগেই টের পেয়েছিলেন। তা না হলে বাঙালিদের প্রতি এত ইঙ্গিতময় অথচ স্পষ্ট নির্দেশনা আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি শালীন হুশিয়ারি তিনি করতে পারতেন না। তার মধ্যে অঘাত বিশ্বাস ছিল, এই বাঙালি আর থামবে না। পরাধীনতার শিকল ভাঙতেই হবে এবার। তিনি আবারও বললেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

সেদিনে সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিসত্তা ও জাতিগত চেতনার মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন। তিনি সচেতনভাবে, সুকৌশলে পাকিস্তানিদের শাসন, শোষণ ও পীড়ন থেকে এ দেশের জনগণকে মুক্ত করে-স্বাধীনতা অর্জনের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। অকুণ্ঠচিত্তে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় …সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব—এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধু কণ্ঠের সেই জয় বাংলা তখন মুক্তিকামী স্লোগান হয়ে গেল। আর এই ভাষণটি হয়ে গেল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার অনন্য দলিল। জয় বাংলা মূলত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগান। এই স্লোগান বাংলার এবং বাঙালির স্লোগান। এই স্লোগানের চেতনায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি হিসেবে যুদ্ধে নেমেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠের এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে নয় মাসের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতী ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে।

লেখক : শিক্ষক, কবি ও কলামিস্ট
monifoyzunessa@gmail.com

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: খোলা বাতায়ন

Leave A Reply

Your email address will not be published.