শুক্রবার ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ শুক্রবার

কবি কাব্যসেবী সুর বুলবুলি মনন সম্পাদক আনজুমান আরা অনু

মোঃ শামীম চৌধুরী: চলে গেলেন নারায়ণগঞ্জ সঙ্গীতাঙ্গনের সু-পরিচিত মুখ সুর ও সঙ্গীত সাধক সদা হাস্যোজ্জ্বল বিনয়ী প্রাণের আলোচিত কন্ঠশিল্পী আনজুমান আরা অনু।
গত ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ রবিবার রাত তিনটার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নতুন বিল্ডিং-২ এর ৮ তলা ৮০১ মেডিসিন মহিলা বিভাগ, ৮নং রুমের ৪৩নং সিটে রক্তের পটাসিয়াম ও হিমোগ্লোবিন সমস্যার কারণে অস্থিরতায় কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্সদের অপেক্ষায় সঠিক চিকিৎসার অমানুষিক অবহেলায় “ভাল লাগেনা” “ভাল লাগেনা” “আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও” একই কথা চার দিন চার রাত জপে জপে অসহ্য অস্থিরতার যন্ত্রনায় ভূগে ভূগে সবাইকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চির নিদ্রায় পাড়ি জমালেন বাংলাদেশের সু-কন্ঠি ৮০/৯০ দশকের গোল্ডেন ভয়েজ খ্যাত কন্ঠ তারকা আনজুমান আরা অনু।
“এই গানই আমার জীবন মরন গানই যেন প্রাণ” এন্ড্রোকিশোরের গাওয়া এই গানের বানীকে মনে প্রাণে লালন করেই জীবন সঙ্গী হিসেবে ১৯৮৩ সালে বেছে নিয়েছিলেন গানের মানুষ সুরকার ও কন্ঠ শিল্পী এস এ শামীমকে। সাধ-স্বপ্ন-আশা আর সবটুকু ভালবাসায় ঘেরা ৩৫ বৎসরে তিল তিল করে নিজের হাতে সাজানো গুছানো সুখের সংসার, রাজু – সাজু-মনি নামে দুই ছেলে ও এক মেয়ে, জীবন সঙ্গী এস এ শামীম, রাজ ও আপন নামে’র দুই নাতি নাতনী সহ রেখে গেলেন শিল্প সাহিত্যাঙ্গনের সর্বস্তরের কবি-সাংবাদিক-শিল্পী-ভক্ত-শ্রোতা-স্বজন-সুজন ও বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের অসংখ্য গুণগ্রাহীদের। সকলের প্রাণ প্রিয় ছিলেন কন্ঠ শিল্পী ও সংগঠক আনজুমান আরা অনু। অনু’র জনপ্রিয়তার সবচাইতে লক্ষনীয় যে বিষয়গুলো ছিল তা হলো পরিবেশ ও শ্রোতাদের মন বুঝে শ্রুতি মধুর সুরেলা কন্ঠে সব ধরনের গান পরিবেশন করা। হাসিমুখে শত মানুষকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ানো, কুশলাদী বিনিময়ে সুখ দুঃখের ভাগিদার হওয়া,পরিমার্জিত আদর্শতায় ছেলে মেয়ে স্বামী সংসার সামলানো আর মনন সাহিত্য সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাংগঠনিক তৎপরতায় অনুষ্ঠান করানো। কন্ঠশিল্পী সঙ্গীত তারকা আনজুমান আরা অনু ছিলেন অসাধারণ মমতাময়ী নিবেদিত প্রাণের একজন মানুষ। গানের এই মরমী পাখী অনু’র সাথে ছোট বড় সবারই ছিল মমতাময় মধুর সম্পর্ক। অনু’র জীবন সঙ্গী বহু গুণের অধিকারী এস এ শামীম একজন সুর বোদ্ধা গানের ওস্তাদ। তিনি সুরের ভূবনে আরেক নক্ষত্র। অনু ও শামীম এই দুই কন্ঠশিল্পী দম্পত্তিই ছিল ক্লাসিক সঙ্গীত ঘারানার সুর সাধক। সঙ্গীত ও সাংগঠনিক তৎপরতায় সুনামর্জিত স্বামী-স্ত্রী এই জুটি নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের স্বার্থক শিল্পী দম্পত্তি ছিলেন। কন্ঠশিল্পী আনজুমান আরা অনু’র স্থায়ী ঠিকানা স্বামীর ভিটামাটি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা চৌধুরী বাড়ীর মার্ক ভিলায় হলেও পৈত্রিক ভিটা ছিল মুন্সিগঞ্জের ভাগ্যকূল গ্রামে। তৎকালীন নদী ভাঙ্গনে পুরো পরিবার নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ ডাইলপট্টি সূতার পাড়ায় বসতী গড়েন। ১৯৭০ সালে দেশ আন্দোলনের মুখোমুখি নারায়ণগঞ্জেই তার জন্ম। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে অনু ছিলেন সবার কনিষ্ঠ। পারিবারিক ইচ্ছার প্রাধান্যতায় বাবা ও কাকা’র অনুপ্রেরণায় অনু’র মনে সুরের বাসা বাধা। মাত্র চার বৎসর বয়স থেকেই অনু’র গানের চর্চা শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন গানের স্কুল ওস্তাদ নিত্য সাহা’র সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকেই প্রথম গানের হাতে খড়ি। সঙ্গীত গুরু নিত্য সাহা’র সব চাইতে স্নেহভাজন ছাত্রী ছিলেন আনজুমান আরা অনু। অতটুকুন বয়সেই অনু হারমুনিয়াম বাজিয়ে কিভাবে গান করতে হয় অবাক করার মত রপ্ত করে নিয়ে ছিলেন। অনু’র সঙ্গীত গুরু নিত্য সাহা’র আদর মাখা সুনিপূন দৃষ্টি দীক্ষায় নজরুল-রবীন্দ্র ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে অনু ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে উঠেন সেই শিশুকাল থেকেই। ওস্তাদ নিত্য সাহা’র পরলোক গমনে একরাশ ব্যথাতুর মন নিয়ে থেমে থাকেননি সুরপাখী অনু’র সুর দীক্ষা। অতঃপর নারায়ণগঞ্জের সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত বিদ্যালয় জয় জয়ন্তী জলসা সঙ্গীত একাডেমীতে সঙ্গীত গুরু মোহাম্মদ আবু তাহের এর নিকট উচ্চাঙ্গ ও নজরুল সঙ্গীতে দীর্ঘদিন তালিম গ্রহন করেন। গান পাগলী আনজুমান আরা অনু শিশু থেকে কৈশরতা কালীন পড়াশোনার পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের বেসিক ঠিক রেখে সঙ্গীত প্রাধান্যতায় নজরুল-রবীন্দ্র-আধুনিক- হাসন-লালন-পল্লীগীতি-লোকগীতি-গজল-ঠুমরী-হিন্দি-উর্দু সব ধরনের গান অনায়াসে সাবলিলভাবে তার শ্রুতি মধুর কন্ঠের পরিবেশনায় নিজের অর্জিত সুর দক্ষতা জাহিরে বোদ্ধা শ্রোতা সুধী মহলে একটা নিজের শক্ত অবস্থান করে নিয়েছিলেন। অনু’র বেশীর ভাগ আত্মীয় স্বজনের বসত ভিটা ছিল ভারতের কোলকাতায়। সেই সুবাদে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য অনুকে যখন তার পারিবারিক ভাবে চাপ প্রয়োগে কোলকাতায় নেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল, অনু তখন সুর সঙ্গীতের মায়ায় নিজের অন্তরে লালিত শিল্পী সত্বাকে নিজ জন্মভূমিতে ছড়িয়ে দেয়ার অভিপ্রায়ে স্বপ্ন ও সাধ পূরনের আশায় এক কাপড়ে প্রিয় গানের স্বরলিপি খাতাটিকে বুকে আগলে বাড়ী থেকে পালিয়ে তার পরিচয় বন্ধনের বিশ্বস্থ সুর বন্ধু কন্ঠ শিল্পী এস এ শামীম এর কাছে আশ্রয় নেন। শত অনুনয় বিনয় আর বুঝ এর মাধ্যমে সে বাসায় যেতে অপারগতা দেখিয়ে ১৯৮৩ সালে’র ২৮ শে জুলাই সুরবন্ধু কন্ঠ শিল্পী এস এ শামীম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অনু’র পাষন্ড পরিবারের একমাত্র বাবা অনু’র বিয়ের ১ মাস পর মেয়েকে দেখে যান এ ছাড়া আর কেউ কোনদিন অনু’র খোঁজ খবর রাখেনি বা নেয়নি। সুরপাখী অনু’র পরিবার থেকে সেই চলে আসা আর দীর্ঘ অতিক্রান্ত ৩৫ বৎসর পর এই চির চলে যাওয়া তাদের পরিবারের ছিঁটেফোটা কোন আবেদন নিবেদন দয়া মায়া কোন রূপ ভ্রুক্ষেপ ছিল না এমনকি তারা কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগই রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। অনু’র বাবার বাড়ীর এ বিচ্ছিন্নতার অপ্রকাশিত চাপা কষ্ট যন্ত্রনা আর ভাবনা গুলো ভুলিয়ে রেখেছিল তার সঙ্গীত, ছেলে মেয়ে আর জীবন সঙ্গী এস এ শামীম এর মমতা মাখানো ভালবাসা।
১৯৮৫ সালে ঢাকা’র ডিসকো রেকর্ডিং থেকে বাজারে প্রকাশিত এস এ শামীম এর প্রথম গানের অডিও অ্যালবাম “রফির স্মরনে” আধুনিক বাংলা ৪ টি গানে ডুয়েট কন্ঠ দেন অনু।
১৯৯৫ সালে নিজ প্রতিষ্ঠান মার্ক অডিও ভিডিও সেন্টার থেকে “ক ফোটা চোখের জল” শিরোনামে ১৬ টি গান নিয়ে অনু’র প্রথম একটি রিমিক্স একক গানের অ্যালবাম বের হয়। ১৬ টি গানই ছিল উপ মহাদেশের প্রখ্যাত কন্ঠ শিল্পী মান্নাদে’র গাওয়া শ্রেষ্ঠ গান। তাঁর অনুকরণ ও অনুস্মরণে গাওয়া বাংলাদেশে একমাত্র প্রথম মেয়ে শিল্পীই ছিলেন আনজুমান আরা অনু।
অ্যালবামটি মাত্র ২ মাসে ৩০ হাজার কপি বাজার কাটতিতে দেশ বিদেশের শ্রোতা মহলে অনু প্রশংসিত সাড়া পায়। প্রথম অ্যালবামের অসামান্য সাফল্যতায় মার্ক এর প্রযোজনায় ১৯৯৭ সালে উপমহাদেশের আরেকজন বিখ্যাত কন্ঠ শিল্পী লতা মঙ্গোসকারের গাওয়া ১৬ টি সুপার হিট হিন্দি গানের সুরে এস এ শামীমের লেখা নতুন কথায় আধুনিক বাংলা “অন্তরের ব্যথা’ নামক অনু’র ২য় অডিও অ্যালবাম সমান্তরাল ভাবে বাজার কাটতিতে শ্রোতাদের মাঝে সাড়া ফেলে। পর পর দুটি অ্যালবামেরই মিউজিক কম্পোজিশনে ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক ঈদুল বাসার রাহী। অনু’র রিমিক্স অ্যালবাম দুটির পরিবেশনার দায়িত্বে ছিলেন দেশ বিদেশের বড় বড় অডিও ক্যাসেট কোম্পানি গুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাউন্ডটেক, সঙ্গীতা, সোনালী, কেটি সিরিজ, বিউটি কর্নার, সামাদ ও শাহীন ইলেক্ট্রনিকস সহ অনেক গুলো ক্যাসেট কোম্পানি।
১৯৮৭ সালে সুর স¤্রাট শেখ সাদী খানের সঙ্গীত পরিচালনায় চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা সিরাজ হায়দারের আদম বেপারী ও চিত্র পরিচালক কোরবান আলীর এক ফুল দুই মালী নামে দুটি চলচ্চিত্রে আনজুমান আরা অনু প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে গান করেছিলেন। একটি গান রুনা লায়লা’র সাথে অন্যটি কিশোর নামে একজন সিঙ্গারের সাথে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার এর তালিকা ভূক্ত শিল্পী ছিলেন অনু। তিনি একাধারে বেসরকারী সবগুলো চ্যানেলেই বিশেষ দিনের বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে গান পরিবেশন করতেন।
আনজুমান আরা অনু ঢাকা’র বিখ্যাত নাট্যদল পদাতিক নাট্য সংসদ এর সদস্য ও নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় আওতাধীন টি এস সি আবৃত্তি সংগঠন বিশ্বকলা কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট, চয়ন সাহিত্য ক্লাব এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমী’র নির্বাচিত নির্ধারিত কন্ঠশিল্পী ছিলেন।
অনু’র সুর পারদর্শিতা ছিল নজরুল সঙ্গীতে, তার ভেতরে ছিল জানা অজানা অসংখ্য নজরুল গীতির সংগ্রহ সম্ভার। তাইতো অনু ছিলেন মার্ক সঙ্গীত একাডেমীর নজরুলগীতির প্রশিক্ষক। অনু ছিলেন নিজের গড়া মার্ক মিউজিক্যাল ব্যান্ড এর অন্যতম প্রধান ভোকালিষ্ট সিঙ্গার।
২০১৭ সালে নিউইয়র্ক প্রবাসী কবি সাংবাদিক দর্পন কবীরের লেখা এস এ শামীম এর সুর ও শেখ সাদী খানের মিউজিক কম্পোজিশনে একটি সিডি অ্যালবামের ৪ টি গান অনু নিজের কন্ঠে রেকর্ড করে বিখ্যাত দুই গুনী শিল্পীকে তার অনুকরণে “নক্ষত্রের ফুল” নামক অ্যালবামে গাওয়ার জন্য তাদের কাছে পাঠিয়েদেন। কন্ঠ শিল্পী অনু’র কন্ঠের গায়কী সুরে দুটি গান অনুসরনে কন্ঠে তুলে নিয়ে অ্যালবামের জন্য গেয়েছেন দেশের বিখ্যাত কন্ঠ শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন এবং আরও দুটি গান অনু’র অনুকরনে গেয়েছেন ভারতের এ সময়ের বিখ্যাত শিল্পী শুভমিতা ব্যানার্জী। শিল্পীদ্বয় জানতেন অনুর ঠান্ডা জনিত কারনে গলা বসায় গান গাইতে পারেননি। বিখ্যাত দু’জন শিল্পীই অনু’র কন্ঠের তারিফ করে প্রশংসা বার্তা পাঠিয়েছেন। তাদের এমন বার্তায় অনু প্রচন্ড খুশীতে নিজেকে বেশ গর্বিত মনে করে বলে ছিলেন “উনাদের মত শিল্পীদের স্বিকৃতি স্বরূপ বার্তায় আমার শিল্পী জীবন ও সুর সাধনা সত্যি নিজেকে আমি ধন্য মনে করছি”।
আনজুমান আরা অনু’র সঙ্গীত গুরুদের অনু সম্পর্কিয় মন্তব্য ছিল “অনু’র সুর ধাবন কোচিং পাওয়ার ক্ষমতা ছিল অবিশ্বাস্যময়, যে কোন জটিল ও কঠিন ক্লাসিক সুর অনায়াসে তার শ্রুতিমধুর সুরেলা কন্ঠে সাবলিল ভাবে পরিবেশন করতে পারতেন যা সত্যি সাধন করত আল্লাহ প্রদত্ত পাওয়া। সর্বস্তরের কবি ও শিল্পীদের প্রিয় মনন সাহিত্য সংগঠনের মনন চত্বরটির মূল প্রেরণা ও পরিকল্পনা ও উদ্যোগতা ছিলেন আনজুমান আরা অনু।
মনন এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত চারন কবি মনির চৌধুরী মনু মারা যাবার পর অনুগত ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মনন এর সাধারণ সম্পাদকের পদটি বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। আজ মনন ফেলে মনু’র মত অনুও চলে গেলেন না ফেরা অচিন পুরের দেশে। মনন সাহিত্য সংগঠনের সাধারন সম্পাদক কন্ঠ শিল্পী অনু ছিলেন অসংখ্য কবি ও শিল্পীদের কাছে একজন শ্রেষ্ঠ সংগঠক এবং নিবেদিত মন ও প্রাণের অলসতাহীন সেবিকা। মনন এর প্রথম সাহিত্যাসর থেকে ৬৫ তম সাহিত্যাসর সব গুলুই ছিল তার তাগিদি ইচ্ছা আর অনুপ্রেরণার সফল আয়োজন। নিজ ও নিজের সন্তানদের জমানো পয়সায় প্রতিটি সাহিত্য সভার আয়োজনে আগত ৭০ থেকে ৮০ জন কবি শিল্পী পাঠক শ্রোতাদের জন্য থাকতো নিজ হাতে তৈরী করা চা নাস্তা থেকে শুরু করে পোলাউ, বিরানি, খিচুরি সহ বিভিন্ন আইটেমের ভূরি ভোজে রাতের খাবার। অনু কখনো কাউকে না খাইয়ে বিদায় দিতেন না। মানুষকে খাওয়ানোই ছিল শিল্পী অনু’র আত্মার তৃপ্ততা ও পরম শান্তি। প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখী উৎসবে মননের আয়োজনে মনন চত্বরে কবিতা আর গানে গানে শিল্পী কবিদের নিজ হাতে রান্না করা পান্তা ইলিশ ও নানা আইটেমের ভর্তা পরিবেশনায় সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন যা কখনো কেউ কোনদিন ভুলতে পারবে না। অনু কথায় কথায় প্রায়ই মনন পরিবারের সদস্যদের বলতেন “আমি মরে গেলে কবি শিল্পীরা আর কিছু না হোক আমার নামটাতো স্মরন করবে? ”
আশি ও নব্বই দশকের সুর যোদ্ধা ও সুর বোদ্ধা কন্ঠ শিল্পী আনজুমান আরা অনু সর্বদাই অপসাংস্কৃতির বিরোধীতায় ছিলেন। তিনি বর্তমান ডিজিটাল দেশকে অয়েষ্টার্ন বাদ্য যন্ত্রের দাপট ও সয়লাবে বেসিক না জানা শিল্পীদের দৌরাত্ব ও নাচুয়া দর্শক শ্রোতা দ্বারা সঙ্গীতের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন বা রেখেছিলেন। অনু বুঝতে পেরেছিলেন সমসাময়িক শিল্পী শ্রোতা আয়োজক প্রযোজকদের কাছে গুণী বোদ্ধা ক্লাসিক শিল্পীদের কোন মূল্য নেই। সঙ্গীতের বেসিক জানা শিল্পীরা এখন ওদের কাছে ব্যাকডেট অচল মাল। গান এখন আর শোনার জিনিস নয় দেখার জিনিস। অনু গান গাইতেন আর বলতেন “গানতো আর ছাড়তে পারবো না, গান করবো, তবে তা নিজের আত্মতৃপ্তির জন্যে এবং নিজেকে নিজে শোনাতে”।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লাহ’র ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী বাড়ীর মার্ক ভিলা, মনন চত্বর অবস্থিত মনন সাহিত্য সংগঠন এর সভাপতি, মার্ক সঙ্গীত একাডেমীর অধ্যক্ষ কবি সাংবাদিক, কন্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও সংগঠক এস এ শামীম এর অতীত বর্তমান খ্যাতি ও শিল্প সাহিত্যের উজ্জ্বলতাময় প্রতিটি ধাপেই ছিল তার সহধর্মিনী সাদা মনের মানুষ কন্ঠ শিল্পী আনজুমান আরা অনু’র উৎসাহ, স্বাধিনতা আর অনুপ্রেরণা। এস এ শামীম এর অর্ধাঙ্গিনী সুরের সাথী কন্ঠ শিল্পী আনজুমান আরা অনু মাত্র ৩৫ বৎসরের বিবাহিত জীবনে স্বামী, সন্তান, স্বজন, সুজন, সমাজ, সংসার, সুর সঙ্গীত, সাহিত্য, মানব সেবা, সংগঠন, হাজারো স্মৃতি আর হাজারো ভক্ত ‘শ্রোতা গুণগ্রাহীদের রেখে মাত্র ৪৫ বৎসর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে ডাক্তার আর নার্সদের অবহেলিত চিকাৎসাধীন অবস্থায় শুয়ে বসে সঙ্গীত অঙ্কুর ছোট ছেলে রেজানুর রহমান বাবন এর হাতে এক ঢোক শেষ পানি পান করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে গানের বুলবুলি অনু নিরবে মনন পরিবারের খাঁচা ভেঙ্গে চিরতরে না ফেরার দেশে উড়ে চলে গেলেন। প্রাণখোলা সুর ও মানব দরদী গানের বুলবুলি এস এ শামীমের স্ত্রী আনজুমান আরা অনু আজ শান্ত হয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে আছে নিজ বসত ভিটা’র ২০০ গজ দূরে মসজিদের পাশে নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানের সমাধীতে। তার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।

লেখক:  ইতিহাস গবেষক।

Categories: খোলা বাতায়ন,সাহিত্য

Leave A Reply

Your email address will not be published.