বৃহস্পতিবার ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ ২৮ মার্চ, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

সোহাগ সিদ্দিকীর কাব্যগ্রন্থ ‘অপূর্ণতায় পূর্ণ’ : একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া

আবুল কাইয়ুম : সম্প্রতি প্রকাশিত হলো কবি সোহাগ সিদ্দিকীর (জন্ম-১৯৬৩) কাব্যগ্রন্থ ‘অপূর্ণতায় পূর্ণ’। কাব্যটির সবগুলো কবিতাই ছন্দোবদ্ধ ও শ্রুতিনন্দন। সে সাথে কবির আত্মদর্শন, হিতকথন কিংবা ইতিবাচক জীবনবোধের উসাৎরণে কবিতাগুলো ঋদ্ধ হয়েছে। সোহাগ সিদ্দিকী জীবনবাদী কবি; তাঁর কবিতায় মানবজীবনের শ্বাশ্বত স্বরূপ ধরা পড়েছে। জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব কষা, জীবনের মানে খোঁজার তাড়না কিংবা জীবনে পুঞ্জিভূত আঁধার সরিয়ে আলোকিত হবার দৃপ্ত ইচ্ছে –এ সবের মাঝে কবির ইতিবাচক জীবনচৈতন্যই প্রকাশ পেয়েছে এ কাব্যে। তবে এর মাঝে আবার একটু ধন্ধ, বাউলদের মতো ইঙ্গিতময় একটু মরমী সুরও লক্ষ করা যায়; যেমন- “নিজেরে কী বুঝি আমি/ চিনি ঠিকঠাক!” কিংবা “জীবন চিনতে গিয়ে জীবনটাই শেষ” (আপন খবর)। কিন্তু জীবনকে জানতে গিয়ে পথের দিশা না পাওয়ার ভাব কিংবা জীবনকে একটি নাটক মঞ্চায়নের সাথে তুলনা করা সত্ত্বেও কবি মৃত্যু দিয়ে জীবনকে আবৃত করার মোহান্ধতায় ভোগেননি। তাই তো তিনি বলতে পারেন-

মৃত্যু যে অমোঘ সত্য তার চেয়েও সত্য
জন্ম ও জীবনের সত্য বেঁচে থাকা সত্য
মৃত্যুকে সাজাতে নেই জীবন সাজাও
মৃত্যুর গানও নয় জীবনের গান গাও
(জীবনের আবীরে মৃত্যু)

কবিরা কথা বলেন পরোক্ষে, তাঁদের ভাষায় যে ইঙ্গিতময়তা পরিদৃষ্ট হয় তা পাঠক হিসেবে আমাদেরকে ভাবায়। তাঁদের আত্মকথনের মাঝে প্রকাশিত সত্যের আভাষগুলো মানুষের জীবনসত্যকে উন্মোচিত করে। কবি হয়ে ওঠেন মানুষের কবি, তাঁদের একান্ত আপনজন। কবি সোহাগ সিদ্দিকীও তার ব্যতিক্রম নন। কবির বোধটি কীভাবে জনসংলগ্ন চেতনার অনুরূপ হয়ে উঠেছে তাঁর প্রকাশ আমরা তাঁর বিভিন্ন কবিতায় লক্ষ করি। ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত মানবিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে কবির আত্মগত অনুভূতিটি এরকম-

নিজের ভেতরে নিজে থাকা বড় দায়
অসুর সুরের টানে কী যে অসহায়
(বাতাসের জাদু)

কবি মানুষকে বড় ভালো বাসেন, মানুষই নান্দনিক ভাষায় তাঁর কবিতার মুখ্য উপজীব্য হয়ে উঠেছে। তিনি বারবার জীবন ও মানুষের নানা চালচিত্র এঁকেছেন, মানুষের মাহাত্ম প্রকাশ করেছেন, মানুষে মানুষে সৌভ্রাত্যের মেলবন্ধন কামনা করেছেন, মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়েছে এই ভাষা, “মানুষের মতো ফুল মেলেনি কখনো’। তাই তো মানবপ্রেমিক কবির উচ্চারণ-

মানুষের চেয়ে বড় ঠিকানা মেলেনি
ভালো বাসা হয়ে ওঠে ভালোবাসা হয়ে
আমি শব্দ শয্যা নিয়ে বসে থাকি রোজ
মানুষ ঘুমাবে এসে মানুষের ওমে।
(জীবন ও মানুষের গল্প)

জীবন ও মানুষের বার্তাবহ কবিতাগুলো ছাড়াও কবি এই কাব্যে স্বদেশ, পৃথিবী, প্রকৃতি, প্রেম সহ নানা বিষয়ে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। সমকালীন পৃথিবীর দুর্দশার ছবিটি তিনি এভাবে তুলে ধরেছেন-

অশান্তির চাষাবাদ পৃথিবীর বুকে
দেখি আয়নামতির আরশীনগরে-
বিশ্বাসের প্রণয় থালায় নীল ঢেলে দেয়
চোখের লেবাসে এক অন্ধ অজগর।
(বিপরীত সহবাস)

এই শান্তিকামী কবি আবার মোক্ষম নিসর্গপ্রেমীও। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও কবিতার নান্দনিকতা একাকার হয়ে ঝরে পড়ে তাঁর কবিতা থেকে-

পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটে পদাবলী সুর
চোখের দৃষ্টিতে দেখি ফাগুনের রঙ
আষাঢ় শ্রাবণ আনে জলের আগুন
সম্পর্কের ইতি টেনে সব যুক্তাক্ষর
পাঠকের কাছে আজ সহজ কবিতা।
(শুধু সেই চোখ)

সোহাগ সিদ্দিকীর কবিতার চিত্রকল্পগুলো গভীর অন্তর থেকে উঠে আসা এমন ছবি যাতে রয়েছে অন্তরেরই পুরো ছাপ। হৃদয় থেকে উৎসারিত এ সব ছবিই তাঁর কবিতাগুলোর অধিকাংশ এলাকা জুড়ে। চিত্রকল্পগুলো খুব তরতাজা, স্বাদু, দৃষ্টিনন্দন। তিনি সমসাময়িক জীবন ও পরিপার্শ্ব থেকে তুলে এনেছেন কবিতার নানা অনুষঙ্গ, তার সাথে যুক্ত হয়েছে এসব নিসর্গাশ্রয়ী চিত্রকল্প। তিনি যেমন দেখেছেন তেমনই এঁকেছেন। পরাবাস্তবতা, বিমূর্ততা বা অবাস্তবতার খেলায় মজেননি তিনি। “বুক পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে নীল জলে/ ভেসেছে আমার ভোর দুপুর গোধূলি” কিংবা “শব্দ বাগানে ফোটা গোলাপের মতো/ জানি তোমার স্বপ্নেরা ফুটে থাকে রোজ” –এমন সুন্দর চিত্রকল্প গড়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। শব্দবিন্যাসেও কবি যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি ছান্দসিক কবি বলেই বাণীবন্ধে ছন্দময়তা ছড়িয়ে দেবার জন্য সুসমঞ্জস ধ্বনি আরোপ করার উপযুক্ত শব্দাবলী প্রয়োগ করেছেন। অন্ত্যমিল প্রয়োগ করুন আর না-ই করুন, তাঁর অধিকাংশ কবিতাই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা; অবশ্য স্বরবৃত্তেও কয়েকটি কবিতা লিখেছেন এবং একটি মাত্রাবৃত্তে লেখা কবিতাও আমার চোখে পড়েছে। অক্ষরবৃত্তের কবিতাগুলো প্রায়শ পয়ারের আদলে চতুর্দশপদী কবিতা। এগুলোকে এজন্য সনেট বলা যাবে না যে, সনেটের অষ্টক-ষটক বিন্যাস ও বিশেষ অন্ত্যমিলরীতি এসব ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি। কাব্যটিতে ত্রিপদী ছন্দেরও একটি কবিতা দেখা গেল। মুক্তক ছন্দেও তিনি একটি কবিতা লিখেছেন। প্রবহমান ও অপ্রবহমান –এ উভয় ভাষিক বিন্যাসে তাঁর ছন্দোবদ্ধ কবিতাগুলো লেখা হয়েছে। অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত –এই তিন ছন্দেরই প্রয়োগে কবি সিদ্ধহস্ত; নিম্নে এর দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:-

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিল-

এক থালা সাদাভাত / লঙ্কাপোড়া নুন
প্রিয়তা ফুলের রূপ / গন্ধের উনুন
ভুলে যদি যাই সেই / নদীর পরাণ
তার জলশরীরে টিপ / রজঃস্বলা বান
(বোবা শব্দে জোড়াচোখ)

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলহীনতা-

তবু্ও চোখের তৃষ্ণা/ কানের ব্যস্ততা
পায়ের যে শক্তি আর/ হাতের যে দুঃখ
কিছু উপেক্ষা করা/ হবে না আমার
তোমার কাছেই যাবো,/ চেনা অচিনপুর
(যাবো চেনা অচিনপুর)

স্বরবৃত্ত ছন্দ-

ঘরে মানুষ / বাইরে মানুষ, / মানুষ কত / রঙের
দেখি মানুষ / নানা রকম, / মানুষ কত / ঢঙের
কোন মানুষ / আপন দেখ / কোন মানুষ / পর
মানুষ দেখে / সাহস বাড়ে / মানুষ দেখে / ডর!
(মানুষ এবং মাটি)

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ-

পথে নেমে আজ / পথ খুঁজে মরি
দিশাহারা হয়ে / কোনপথ ধরি
পথের ঠিকানা / নাই।
মন্ত্রের পথ / তন্ত্রের পথ
শান্তির পথে/ হিংসার রথ
কোন পথে বল / যাই।
(পথের সুর)

কবি সোহাগ সিদ্দিকীর কবিতার ভাষাবন্ধ সহজ ও সাবলীল, কিন্তু বৌদ্ধিকতার স্পর্শে গভীর অর্থময়তার দ্যোতক ও নান্দনিক। তিনি একটি কবিতায় বলতে চান অনেক কথা। সুচয়িত শব্দমালার বুননে ভাষায় কমনীয়তা ছড়িয়ে তাঁর অনুভূতিগুলো মূর্ত করে তোলেন তিনি। সবদিক দিয়েই এ কাব্য সার্থক ও সুন্দর হয়ে উঠেছে বলে আমার বিশ্বাস। আশা করা যায়, কাব্যটি পাঠকের কাছে আদৃত হবে।

একুশে বইমেলা, ২০১৮ উপলক্ষে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পরিবার পাবলিকেশনন্স, ঢাকা। এর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী চারু পিন্টু। গ্রন্থটির কাগজ, বাঁধাই, অঙ্গসজ্জা ও ছাপা উন্নত মানের। পাঁচ ফর্মার এই গ্রন্থের মূল্য ১৪০ টাকা।

লেখক: প্রবন্ধকার, সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক ও কবিতাকর্মী।

Categories: সাহিত্য

Leave A Reply

Your email address will not be published.