শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প ভাবনা

  • সামাজিক নির্দেশনা,
    ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, আর্থিক

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: সহায়তার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোকে শক্তিশালী করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি প্রদানের পথ কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ। কর্জে হাসানা ইবাদত এবং মানবতার পুণ্যময় কল্যাণ। মহানবী (সা.) এর ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব ১০ গুণ আর ঋণ
প্রদানের সওয়ার ১৮ গুণ

দারিদ্র্য মূলত জাতীয় অভিশাপ ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। সম্পদের অসম প্রতিযোগিতায় কিছু ভাগ্যবান মানুষ কোটিপতি হয় এবং বিপুলসংখ্যক দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে বঞ্চিত হয়। দারিদ্র্য জনগণের সামাজিক কল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করে এবং অপরাধপ্রবণতার সূচক ঊর্ধ্বমুখী হয়। ভূমিহীন ও প্রান্তিক পরিবার মানবাধিকার, পর্যাপ্ত খাবার, বিশুদ্ধ পানীয় জল, পরিধেয় বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও স্যানিটেশনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এর পেছনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতা, পালাক্রমে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, লুটপাট, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান। ২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গোটা বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ১.২৯ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ভারতে এবং ১৭৩ মিলিয়ন রয়েছে চীনে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৬৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৬ কোটি ৩০ লাখ। এর মধ্যে পল্লী অঞ্চলে ২৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, শ্রমের বাজার সৃষ্টি নিশ্চিত হলে দারিদ্র্য সহনীয় মাত্রায় পৌঁছতে বেশিদিন সময় লাগবে না। আদিকাল থেকে সমাজে দারিদ্র্য ছিল এবং বর্তমানেও আছে। সমাজের প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিত্তহীন জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের আত্মনির্ভরশীল করা মানবসেবা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পুঁজিবাদী বিশ্বে দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ব্যবসা করার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়; যার আধুনিক নাম ‘সামাজিক ব্যবসা’ (Social Business) ও ‘ক্ষুদ্রঋণ’ (Micro Credit)। পুঁজিপতিরা বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে এসব অর্থ লগ্নি করে থাকে। এর নেপথ্যে অবশ্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত। পুঁজির যারা মালিক তারা বিনা উদ্দেশ্যে এক পয়সাও বিনিয়োগ করেন না।
বিত্তশালীরা ইসলামী বিধিবিধান মেনে জাকাত, সাদাকাত ও কর্জে হাসানা প্রদান করলে সমাজের অবহেলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলো নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। জাতীয় উৎপাদনে তারা তাদের কর্মশক্তি নিয়োজিত করতে পারবে। সামাজিক নির্দেশনা, ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোকে শক্তিশালী করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি প্রদানের পথ কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ। কর্জে হাসানা ইবাদত এবং মানবতার পুণ্যময় কল্যাণ। মহানবী (সা.) এর ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব ১০ গুণ আর ঋণ প্রদানের সওয়ার ১৮ গুণ। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বিনাসুদে ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ প্রদান করে অসহায় পরিবারগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখাতে পারে। কর্জে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্যবিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিপর্যায়ে কর্জে হাসানা চালু থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেনি।
এ ক্ষেত্রে কিছু অপরিহার্য নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। যেমন কর্জে হাসানা হতে হবে সম্পূর্ণ বন্ধকহীন (mortgage free), দুইজন গ্যারান্টার থাকবেন, যারা ঋণগ্রহীতাকে সত্যায়ন করবেন এবং তার ব্যবসা মনিটর করবেন। ব্যবসার পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যাংক বা ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ সহায়তা দেবেন এবং ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করবেন। ঋণের পরিমাণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবেন, তবে তা সাধারণত ১০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা হতে পারে। ঋণের মেয়াদ ২৪ মাস থেকে ৫ বছর হতে পারে। নিম্নোক্ত খাতে কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ সুফল বয়ে আনতে পারে। যেমন পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, কিচেন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, অটোমেকানিক, হাঁস-মুরগির খামার, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েল্ডিং, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি, ছাগল পালন ইত্যাদি। অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ঋণ দিলে নিরক্ষতা দূরীভূত হবে। কর্জে হাসানায় কোনো ধরনের সুদ, সার্ভিস চার্জ, লোন প্রসেসিং ফি, মুনাফা, জরিমানা নেই। নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরে মূল টাকা ফেরতযোগ্য। ঋণগ্রহীতা ইচ্ছে করলে ঋণের পুরো অর্থের ১ শতাংশ ইন্স্যুরেন্স করতে পারবেন ইসলামী শরিয়া পরিচালিত যে কোনো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। এটা বাধ্যতামূলক নয়, স্বেচ্ছাধীন। ইন্স্যুরেন্স করা হলে ব্যবসার ক্ষতি, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে।
‘ক্ষুদ্রঋণ’ ‘দারিদ্র্যবিমোচন’ সাম্প্রতিক সময়ের খুব আলোচিত পরিভাষা। অভাবগ্রস্ত মানুষের দারিদ্র্যকে কাজে লাগিয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক ব্যবসা পরিচালনার নাম ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ((micro credit)। এর মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন তো হয় না, বরং তৃণমূল পর্যায়ে সুদের বিস্তৃতি ঘটে, তৈরি হয় নতুন কাবুলিওয়ালা। কিছুদিন আগে ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনেমান কর্তৃক নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ’ (caught in micro debt) নামক প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘ক্ষুদ্রঋণ’ দারিদ্র্যবিমোচনে ব্যর্থ। দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক ভূমিকা নেই।
বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ৬৭ শতাংশই ব্যয় করে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্র্যবিমোচনে কোনো ভূমিকাই রাখে না। তাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব নয়। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ আট জেলার খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে এ তিক্ত সত্য ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় এ জরিপ চালানো হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এ জরিপ প্রতিবেদন ‘দারিদ্র্যবিমোচনে দরিদ্র ব্যক্তিদের সম্পদ প্রদানে’র ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, হতদরিদ্র ব্যক্তিদের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দেনাগ্রস্ত শুধু স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর কাছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ২৯ শতাংশ হতদরিদ্র চিকিৎসা বাবদ খরচ করে ও ১৭ শতাংশ দৈনন্দিন খাবার কেনে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ১৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় মৃতের সৎকার, বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং জরুরি সংকট মোকাবিলায়। হতদরিদ্রের ঋণের উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬০ শতাংশ মানুষ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নেয়। দাদনের ঋণ নেয় ১০ শতাংশ।
এছাড়া ১৪ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে, ৭ শতাংশ ব্র্যাক থেকে, ১২ শতাংশ বিভিন্ন এনজিও থেকে ও মাত্র ১ শতাংশ সাধারণ ব্যাংক থেকে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করে না, বরং সামন্ত সমাজের ভূমিদাসের মতো এ যুগের মানুষকে গ্রামীণ ব্যাংক একধরনের ঋণদাসে পরিণত করছে। দারিদ্র্যবিমোচনের এ পথ অনুসরণ করার ফলে আমাদের উন্নতির কোনো দিশা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই সংখ্যালঘুর ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠের গরিব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এ গরিব করা ও গরিব রাখার ব্যবস্থা বহাল রেখে গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চহারে সুদ নিয়ে কীভাবে গরিবি মোচন হবে? এ অস্বাভাবিক ও বিকৃত চিন্তাকেই আমরা দলবলে লালন
করে আসছি।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, সুদনির্ভর ক্ষুদ্রঋণ নয়, বরং সুদমুক্ত কর্জে হাসানা দারিদ্র্যবিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সুখ ও সচ্ছলতার আলোয় আলোকিত হতে পারে দরিদ্রপীড়িত পরিবার। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভাবকে পুঁজি করে ব্যবসা করা কোনোদিন মহৎ কর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এশিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলিম ট্রাস্টগুলো কর্জে হাসানার মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচেনে ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশের বিত্তশালীরা এ বিষয়ে এগিয়ে আসবেনÑ এটাই আমাদের ব্যাপক প্রত্যাশা।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: খোলা বাতায়ন

Leave A Reply

Your email address will not be published.