মোস্তফা কামাল গাজী: সাপ হাত-পা ও মেরুদ-হীন সরীসৃপ প্রজাতির ধূর্ত একটি প্রাণী। বছরে এরা কয়েকবার চামড়া বদলায়। এদের কোনো বহিঃকর্ণ নেই। সেজন্য এরা বাইরের শব্দ নিখুঁতভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তবে মাটি বা অন্য যে কোনো মাধ্যমে এরা শ্রবণ করতে পারে। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ প্রজাতির সাপ বিষধর। বাকি সবই নির্বিষ ও নিরীহ। আর বাংলাদেশেই রয়েছে প্রায় ৮১ প্রজাতির সাপ; বাকি ২৭ প্রজাতিই নির্বিষ। সহজেই দেখা মেলে এমন কয়েক প্রজাতির সাপ হলো ঢোড়া, ঘরগিন্নি, কুকরি, মেটে সাপ, দুধরাজ সাপ, ফণীমনসা, পানি সাপ, দাঁড়াশ, অজগর, গোখরো ও কিছু সামুদ্রিক সাপ।
প্রতি বছর সাপের দংশনে আনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিছু সাপ এমন আছে, যার এক ফোঁটা বিষের কারণে মানুষ মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাই এমন কোনো মানুষ নেই, যে সাপকে ভয় পায় না। এ কারণে মানুষ সাপের প্রতি খুবই বিদ্বেষী। সাপ দেখলেই লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে যায় মারতে। এটা একটা বদভ্যাস আমাদের। কেননা সব সাপ বিষধর হয় না। সাপ দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা হলে মারতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু নিরীহ একটা প্রাণী মেরে কারও কোনো লাভও হয় না। তাছাড়া বিষধর সাপও আঘাত বা বিরক্ত না করা পর্যন্ত দংশন করে না। তাই সাপ মারার আগে আমাদের করণীয় হলো, ওই সাপ আমাদের ক্ষতি করবে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। হাদিসে পাকে সুন্দরভাবে সাপ মারার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে।
আমর ইবনু মুহাম্মদ আন নাকিদ (রহ.) তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘সব সাপ মেরে ফেলো। বিশেষ করে পিঠে দুটি সাদা রেখাবিশিষ্ট ও লেজ কাটা সাপ। কেননা এ দুটি গর্ভপাত ঘটায় এবং দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেয়।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘ইবনে ওমর (রা.) যে কোনো সাপ দেখলে মেরে ফেলতেন। একদিন আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনজির (রহ.) তাকে দেখলেন যে, তিনি একটি সাপ ধাওয়া করছেন। তখন তিনি বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বাড়িঘরে অবস্থানকারী সাপ মারতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ৫৬৩১)। মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘কোনো সাপ মারার আগে তিনবার তাকে সাবধান করবে। এর পরও যদি সে (গর্ত থেকে) বের হয়, তখন তাকে মেরে ফেলবে। কেননা সে হলো শয়তান।’ (আবু দাউদ : ৫১৬৮)।
অনেক সময় জিনেরা সাপ বা বিড়ালের আকৃতি ধরে চলাফেরা করে। বিশেষ করে রাতের বেলা এমনটা হয়ে থাকে। নিহত সাপ যদি আসলেই জিন হয়, তাহলে অনেক সময় নিজ হত্যাকারীকে সে মেরে ফেলে। তাই সাপ মারার সময় জেনে বুঝে ও সতর্ক হয়ে মারতে হবে। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, ইয়াজিদ ইবনে মাওহাব (রহ.) আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন আমি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) এর কাছে এসে বসি। এমন সময় আমি তার চৌকির নিচে কোনোকিছুর আওয়াজ শুনতে পাই। আমি তাকিয়ে দেখি একটি সাপ। তখন আমি দাঁড়ালে আবু সাঈদ (রা.) জিজ্ঞেস করেন, তোমার কী হয়েছে? তখন আমি বললাম, এখানে একটা সাপ আছে। তিনি বলেন, তুমি কী করতে চাও? আমি বললাম, তাকে মেরে ফেলব। তিনি তার বাড়ির একটি ঘরের দিকে ইশারা করে বলেন, এখানে আমার চাচাতো ভাই থাকত। খন্দকের যুদ্ধের সময় সে রাসুল (সা.) এর কাছে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়। কারণ সে তখন নতুন বিয়ে করেছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে অনুমতি দেন আর বলেন, তুমি তোমার হাতিয়ার নিয়ে যাও। সে নিজ ঘরে ফিরে তার স্ত্রীকে ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তার (স্ত্রীর) প্রতি কলম দিয়ে ইশারা করেন। তখন তার স্ত্রী বললেন, তাড়াহুড়ো কোরো না। এসে দেখ কী একটা যেন আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তখন সে ঘরে ঢুকে একটি কালো সাপ দেখতে পায়। সে তাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করে এবং বল্লমে তার দেহ ফুঁড়ে বাইরে নিয়ে আসে।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি জানি না এরপর কে আগে মারা গিয়েছিলÑ লোকটি, না সাপটি। তখন তার জাতির লোকরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলেছে, আপনি দোয়া করুন, যাতে আমাদের সঙ্গী বেঁচে যায়। তখন নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা তার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করো।’ এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মদিনার একদল জিন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাই তোমরা যখন তাদের (সাপ) কাউকে দেখবে, তখন তাকে তিনবার ভীতি প্রদর্শন করবে যে, গর্ত থেকে বের হবে না, অন্যথায় মারা পড়বে। এরপরও যদি সে বের হয়, তখন তাকে মেরে ফেলবে।’ (আবু দাউদ : ৫১৬৭)।
সাপ দেখলেই মেরে ফেলা উচিত নয়। কারণ সাপের বিষ এখন বিষ নয়; বরং কোটি টাকার বাণিজ্যিক পণ্য। বাংলায় ‘বিষে বিষক্ষয়’ কথাটি কেবল প্রবচন হিসেবে প্রচলিত থাকলেও এখন এটি বৈজ্ঞানিকভাবেই স্বীকৃত সমাধান। বর্তমানে মারাত্মক অসুখের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে সাপের বিষ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের বিষেই রয়েছে ক্যান্সারের উৎকৃষ্ট নিরাময়। তাই বিজ্ঞানীরা সাপের বিষকে ওষুধ হিসেবে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের ওপর পরীক্ষা করেছেন ও তাতে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন।
বিদেশে পটাশিয়াম সায়ানাইডের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য গোখরা ও কোবরার বিষ ব্যবহার করা হয়, যা দিয়ে তৈরি হয় জীবনরক্ষাকারী অনেক ধরনের ওষুধ। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ যেসব দেশ রাসায়নিক মৌল বা যৌগ উপাদান তৈরি করে, তাদের কাছে গোখরার বিষ খুবই মূল্যবান। এসব দেশে এক আউন্স সাপের বিষের দাম হচ্ছে কোটি টাকা। বিশেষ করে হার্টের বা স্ট্রোকের মতো রোগের ওষুধ তৈরিতে এ বিষ খুবই কার্যকর। কারণ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হলো থেম্বরোসিস বা রক্তের জমাট বাঁধা। যেসব ওষুধ দিয়ে রক্তের জমাট বাঁধা দূর করা বা প্রতিহত করা যায়, সেগুলোতে রয়েছে অনেক ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কিন্তু সাপের বিষ এ রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে সাহায্য করে। তাই সাপের বিষের মাধ্যমেই এসব রোগের চিকিৎসার চেষ্টা চলছে। এছাড়া সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দরকার, সেটিও বানাতে দরকার পড়ছে ওই বিষের।
সাপ কৃষকের বন্ধু। এরা জমির পোকামাকড় ও ইঁদুর খেয়ে কৃষকের জমিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে ও জমির উর্বরতা বাড়ায়। সাপের খোসা দিয়ে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর তৈজসপত্র ও শিশুদের খেলনা সামগ্রী বানানো হচ্ছে আজকাল। আয় হচ্ছে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু আমাদের রোষে পড়ে বা কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর লোভে পড়ে দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিষধর বেশ কয়েকটি সাপের প্রজাতি। তাই আমাদের উচিত যতটুকু সম্ভব সাপ মারা থেকে বিরত থাকা। আর আমাদের দেশের জলবায়ু সাপের বসবাসের জন্য উপযুক্ত হওয়ায় সরকারিভাবে সাপের প্রজনন ও প্রতিপালন বাড়ানো দরকার। তাহলে আমাদের দেশেও আসবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়