শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

কোরআন-হাদিসে মজুদ প্রসঙ্গ

বিষেরবাঁশী ডেস্ক: খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখেরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা সোনা-রুপা (ধনসম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সংবাদ দিন। সেদিন এসব ধনসম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, এগুলো তো সেসব ধনসম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন কর।’ অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাতে ধনসম্পদ শুধু বিত্তবানদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না হয়।’ এসব আয়াতের তফসিরে বলা হয়েছে, ধনসম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখাকে অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা এতে ধনসম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ ও বণ্টন হওয়ার পরিবর্তে শ্রেণী ও সম্প্রদায়বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে আর সাধারণ মানুষ হয় নিঃস্ব ও দরিদ্র। লেনদেনেও স্থবিরতা দেখা দেয় এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
আল্লাহ তায়ালা দৃষ্টান্তস্বরূপ আল কোরআনে কারুনের ঘটনা উল্লেখ করেন। কারুন ধনসম্পদ জমা করে স্বীয় সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় আচরণ করে এবং যমীনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে, তার ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদসহ জমিনে ধসিয়ে দিয়ে শাস্তি দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কারুন ছিল মুসা (আ.) এর সম্প্রদায়ভুক্ত। সে তার প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল। আমি তাকে এত ধনভা-ার দান করেছিলাম, যার চাবি বহন করা কয়েকজন শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলল, দম্ভ করো না নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালোবাসেন না। আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তা দ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেও না। তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। সে বলল, আমি এ ধনসম্পদ আমার নিজস্ব জ্ঞানগরিমা দ্বারা অর্জন করেছি। সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার আগে অনেক সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন, যারা শক্তিতে ছিল তার চেয়ে প্রবল এবং ধনসম্পদে অধিক সমৃদ্ধ। পাপীদের কি তাদের পাপকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না?’ কারুন ছিল অহংকারী। সে অঢেল ধনসম্পদের মালিক ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে এ থেকে দান করার জন্য উপদেশ দিয়েছিল, কিন্তু সে দান করেনি। বরং আরও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলেছিল, ধনসম্পদ সে নিজ জ্ঞানগরিমায় অর্জন করেছে। আল্লাহ সীমালঙ্ঘন ও অবাধ্যতার কারণে তাকে তার ধনসম্পদ, সহায়-সম্পত্তি ও বাড়িঘরসহ ধ্বংস করে দেন।
ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে অতিমুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। রাসুলল্লাহ (সা.) পণ্য মজুদ করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, ‘যে লোক ৪০ দিন খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।’ অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যদ্রব্য মজুদ করা থেকে বিরত থাকতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘অধিক মূল্যে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য আটক করে রাখতে নবী (সা.) নিষেধ করেছেন।’ যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখে, সে চরম অপরাধী। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘বাজারে পণ্য আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত হয়।’ আল্লামা ইউসুফ কারজাভি এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ব্যবসায়ী দুইভাবে মুনাফা লাভ করে। একটি হচ্ছে, সে পণ্যদ্রব্য মজুদ করে অধিক মূল্যে বিক্রি করার আশায়; অর্থাৎ পণ্য আটক করে রাখলে বাজারে তার তীব্র অভাব দেখা দেবে। তখন যত চড়া মূল্যই দাবি করা হোক না কেন, তা দিয়েই তা ক্রয় করতে বাধ্য হবে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ব্যবসায়ী পণ্য বাজারে নিয়ে আসবে এবং অল্প অল্প মুনাফা নিয়েই তা বিক্রি করে দেবে। পরে এ মূলধন দিয়ে সে আরও পণ্য নিয়ে আসবে এবং তাতেও সে মুনাফা পাবে। এভাবে তার ব্যবসা চলতে থাকবে ও পণ্যদ্রব্য বেশি কাটতি ও বিক্রি হওয়ার ফলে অল্প অল্প করে মুনাফা হতে থাকবে। মুনাফালাভের এ নীতি ও পদ্ধতিই সমাজসমষ্টির পক্ষে কল্যাণকর।’
মজুদদারি সমাজে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। মানুষের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক সময় সমাজের কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। ফলে আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। আর অর্থনীতিতে চরম মন্দা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। আল্লামা ইউসুফ কারজাভি বলেন, মজুদদারি দুইটি শর্তে হারাম। যথা : ১. এমন এক স্থানে ও এমন সময় পণ্য মজুদ করা হবে, যার কারণে জনগণের তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। ২. মজুদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে অধিক মূল্য হরণ, যাতে মুনাফার পরিমাণ অবেক বেড়ে যাবে। আল মুগনি ওয়াশ মারহুল কাবির আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমাদ গ্রন্থকারের মতে, তিনটি শর্তে মজুদদারি হারাম। যেমনÑ ১. পণ্য ক্রয়কৃত হতে হবে। যদি পণ্য আমদানীকৃত হয় বা নিজস্ব উৎপাদিত হয়, আর তা মজুদ করে রাখে, তাহলে ইহতিকার হিসেবে গণ্য হবে না। ২. পণ্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য হতে হবে।
সুতরাং মশলা, হালুয়া, মধু, জয়তুন, গবাদিপ্রাণীর শুকনো খাদ্য ইত্যাদি মজুদ করে রাখলে তা হারাম হবে না। ৩. পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে নিপতিত হওয়া। এর আবার দুইটি পর্যায় রয়েছে। ক. ছোট শহর যেখানে পণ্য মজুদ করলে মানুষের কষ্ট হবে এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় ইহতিকার (মজুদ) হারাম। খ. পণ্য সামগ্রীর সংকট বা অভাবের সময় যদি কোন বণিকদল দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে শহরে প্রবেশ করে আর ধনী লোকরা দ্রুত তাদের কাছ থেকে তা কিনে নেয়, ফলে মানুষের মাঝে পণ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে ইহতিকার হারাম হবে। আর যদি খাদ্যসামগ্রী বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ থাকে এবং কম মূল্যে ক্রয় করা যায়। আর এতে মানুষের কষ্ট না হয়, তাহলে ইহতিকার হারাম হবে না। আল হিদায়া গ্রন্থকারের মতে, পণ্য মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য হতে হবে এবং মজুদদারির কারণে মানুষ ও জীবজন্তুর কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে হবে। আর যদি কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে ইহতিকার করা নিষিদ্ধ নয়।
মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবের অধিকাংশ আলেমের মতে, মজুদদারি সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু হানাফি আলেমদের মতে, মজুদদারি মাকরুহ। রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থকার বলেছেন, মানুষ ও পশুর খাদ্যদ্রব্য মজুদ করার কারণে যদি সেখানকার অধিবাসীদের কষ্ট বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে মজুদ করা মাকরুহ। আর যদি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে মাকরুহ হবে না।
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) এর মতে, মজুদদারি হারাম। তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, এতে আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট ও অনিষ্ট সাধিত হয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তি সব শস্য ক্রয়পূর্বক আটক করে রাখলে অবশিষ্ট সবাই এ থেকে বঞ্চিত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য খরিদ ও মজুদ করে রাখা পাপ।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: লাইফস্টাইল

Leave A Reply

Your email address will not be published.