শনিবার ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ ২০ এপ্রিল, ২০২৪ শনিবার

মূল্যবোধের অবক্ষয়ে পারিবারিক সংকট

ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ: রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জোড়া খুনের দুইটি ঘটনা সামাজিক অস্থিরতার যে চিত্র তুলে ধরেছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। জোড়া খুনের ঘটনায় কাকরাইলে খুন হয়েছেন মা ও ছেলে। ধনাঢ্য পরিবারের গৃহবধূ ও তার ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ছেলের হত্যাকাণ্ডের রেশ না কাটতেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাড্ডার একটি বাড়িতে খুন হয়েছেন বাবা ও মেয়ে। উচ্চবিত্ত পরিবারের মা ও ছেলে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা ও মেয়ের হত্যাকাণ্ডে পারিবারিক বিরোধ জড়িত বলে ব্যাপকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশ এ বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত।

মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষের পারিবারিক জীবনেও সংকট সৃষ্টি করছে। অবক্ষয়ের ভয়াবহতার প্রকাশ ঘটেছে দুইটি জোড়া খুনের ঘটনায়। এ ঘটনা রাজধানীর আইনশৃঙ্খলার জন্য যেমন বিসংবাদ সৃষ্টি করেছে, তেমনি জনজীবনে সৃষ্টি করেছে অনভিপ্রেত আতঙ্ক। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুইটি জোড়া খুন গণমানসে নানা জিজ্ঞাসার জন্ম দিলেও এটি ব্যতিক্রমধর্মী কোনো ঘটনা নয়। এ ধরনের অঘটন প্রায়ই ঘটছে। কালের বিবর্তনে পারিবারিক বন্ধন যত শিথিল হচ্ছে, পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে। কৃষি ও গ্রামভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা পেছনে ফেলে মানুষ দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে নগরজীবনে।
কৃষিভিত্তিক সমাজের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতার যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করত, তা ক্রমেই অপসৃত হচ্ছে। মানুষ ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আত্মীয়স্বজন তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের প্রতিও মমত্ববোধ অনুভব করছে না। কাকরাইলে মা ও ছেলে হত্যাকাণ্ডের জন্য স্বামী ও তার তৃতীয় স্ত্রীকে সন্দেহ করছে পুলিশ। স্বজনদের অভিযোগ, নিহত গৃহবধূ শামসুন্নাহারের স্বামী আবদুল করিম একের পর এক বিয়ে করেছেন স্ত্রীকে না জানিয়ে। বহু নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কও ছিল। স্বামীকে শুধরে আনার চেষ্টা করার কারণেই শামসুন্নাহার প্রতিহিংসার শিকার হন। বাড্ডায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে পেছনে স্ত্রীর পরকীয়া জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, তা ঠেকাতে মূল্যবোধের লালন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি কেন এ অবক্ষয় দানা বেঁধে উঠছে, সে বিষয়েও সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা করে কারণ উদ্ঘাটনে ব্রতী হতে হবে। অবক্ষয় রোধে যা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

পরকীয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক সমস্যায় রূপ লাভ করেছে। একজন মা যে কারণেই পরকীয়ায় আক্রান্ত হোক না কেন, এর পরিণতি তার স্বামী যতটা না ভোগ করে, তার চেয়ে বেশি ভোগ করে তার নাড়িছেঁড়া ধন সন্তান। ব্যাপক বিপন্নতার শিকার হয়ে চরম অসহায়ত্বে প্রতিনিয়ত ভোগে সন্তান। মায়ের কেলেঙ্কারিতে সন্তান লজ্জা ও বিব্রত বোধ করে। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাবা যখন আরেক নারীর সঙ্গে ঘর বাঁধে, তখন সন্তান নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন সন্তান সৎ মায়ের নির্দয় আচরণের শিকার হয়। কেউ কেউ দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু-ফুফাসহ অন্য আত্মীয়ের সংসারে বাবার অর্থায়নে ঠাঁই পেলেও কম-বেশি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়।
সারা দেশেই অপরাধী কর্মকা- জেঁকে বসেছে। একদিকে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে চিহ্নিত অপরাধীরা, অন্যদিকে অপরাধ করেও রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয় পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। আইন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার কারণেই সমাজে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। একটি জরিপ থেকে জানা যায়, মাত্র ১০ শতাংশ মামলায় অপরাধীদের শাস্তি হয়। বাকিরা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, তদন্তের দুর্বলতা, পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ততা ও সদিচ্ছার অভাবসহ নানা কারণে গুরুতর অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। যার কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। একটি অপরাধমূলক ঘটনা ঘটার পর তার তদন্তে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। তত দিনে জন্ম নেয় নতুন নতুন অপরাধীচক্র। সংঘটিত হয় নতুন নতুন অপরাধ। প্রশ্ন হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে? একের পর এক হত্যার ঘটনা কেন ঘটছে। ধরে নেয়া যেতে পারে, ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে শুরু করে ঢিলে হয়ে যাওয়া পারিবারিক কিংবা সামাজিক বন্ধন অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ডে জন্য দায়ী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব অপরাধ দমনের পাশাপাশি সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা। সেই কাজ কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথভাবে করছে বা করতে পারছে?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখানে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, ছিনতাই, খুন ইত্যাদি কমে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। খুন করার মতো অপরাধ যে আজ সমাজে ‘স্বাভাবিক’ অপরাধের পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে, তা কোনোভাবেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। মানুষের নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার সংরক্ষণ করতে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, তবে বাকি মৌলিক অধিকারের সব আয়োজনই হয়ে পড়ে অর্থহীন। খুনি যে-ই হোক, তাকে ধরে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সবক্ষেত্রে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে মানব হত্যা যে সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ, তা প্রমাণিত হতো। খুন-অপরাধপ্রবণতার প্রবাহ কমে আসত। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহল ভাববে এবং এর প্রতিকারে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে─ এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

─ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
advahmed@outlook.com

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: খোলা বাতায়ন,লাইফস্টাইল

Leave A Reply

Your email address will not be published.