শুক্রবার ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ শুক্রবার

দেশে বাড়ছে বিদেশি শিক্ষার্থী!

পাঠান সোহাগ: দেশে প্রতি বছরই বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজগুলোয় আটটি দেশের শিক্ষার্থীরা ভিড় করছেন। একসময় দেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশ যেতেন। আর বর্তমানে বাংলাদেশে আসছেন বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন বাংলাদেশের দিকে।

শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই আসেন ভারত, নেপাল, ভুটানসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে। প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার খরচ কম। ইতোমধ্যে দেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ বিদেশি শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট আকৃষ্ট করতে পেরেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে জীবনাচরণ, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস অনেক মিল রয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজগুলোয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য হোস্টেলের সুবিধা রেখেছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বেসরকারি বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। এতে শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়েছে। দেশের মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার চিত্র অবশ্যই মনে আশার সঞ্চার করে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্রমতে, চলতি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে এক হাজার ৫০০ বিদেশি শিক্ষার্থী দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৬০ জন শিক্ষার্থী। এই ৬০ জন সার্কভুক্ত দেশের শিক্ষার্থী। যদিও ফ্রি বা বৃত্তি কোটায় ১০৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সবাই ভর্তি হয়নি। বাকি এক হাজার ৫০০ জন বিদেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে বাকিরা দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানা গেছে, এবারে এক হাজার ৫০০ জন বিদেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে এক হাজার শিক্ষার্থী ভারত থেকে এবং বাকিরা বেশির ভাগই নেপাল থেকে এসেছে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে দেশের বিভিন্ন মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিল ৯৮৩ জন শিক্ষার্থী, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৮৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৭৫০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই মোট আসনের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে। প্রতি বিদেশি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতিষ্ঠান ভেদে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডলার ফি আদায় করা হয় পাঁচ বছরের জন্য।

অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সূত্র মতে, ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল এক হাজার ৫৪৮ জন। ২০১৪ সালে ছিল এক হাজার ৬৪৩ জন। এর আগের বছর ২০১৩ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল এক হাজার ৬১২ জন। আর ২০১২ সালে ছিল এক হাজার ৬৪২ জন এবং ২০১১ সালে এক হাজার ৬৫১ জন। বর্তমানে সারা দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৯৬টি। তবে ২০১৫ সালে ছিল ৮৫টি।

ইউজিসির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৫৫ জনই পড়েছেন চট্টগ্রামে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ১৪০ জন, তৃতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯১ জন। চতুর্থ অবস্থানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যলয়ে ৮৩ জন এবং পঞ্চম অবস্থানে আছে চট্টগ্রামে অবস্থিত পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ৭২ জন। ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে ৩৬টি দেশ থেকে এ দেশে শিক্ষার্থী এসেছেন। তারা ৩৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী : বর্তমানে সারা দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৩৮টি। ইউজিসির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে দেশের ১৮টি সরকারি বিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ৫৯৩ জন, যা ২০১৪ সালে ছিল ৪৩২ জন। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে ১৬১ জন। আগের বছর ২০১৩ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ৩২৬ জন। তবে ২০১২ সালে ছিল ৫২৫ জন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ইউজিসির প্রতিবেদনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলে বর্তমানে আটটি দেশের ১৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। হল সূত্রমতে, বর্তমানে এই হলে নেপাল থেকে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯৫ জন, মালয়েশিয়া থেকে ১২ জন, ভারত থেকে ৯ জন, ভুটান থেকে ৮ জন, পাকিস্তান থেকে ৩ জন, অস্ট্রেলিয়া থেকে ১ জন, শ্রীলঙ্কা থেকে ১ জন এবং ইরান থেকে ১ জন।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উপপরিচালক সামসুল আরেফিন জানান, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের বিদেশি শিক্ষার্থীল কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ডাটা প্রেরণের জন্য চিঠি দিয়েছি। তারা তথ্য পাঠানোর পরে সমন্বয় করব। তারপরেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে। তবে দেশে বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়ছে এটা আমাদের জন্য আশার কথা।

মালয়েশিয়া থেকে আসা ঢাকা মেডিক্যালে এমবিবিএসে অধ্যয়নরত দেবিন বলেন, বাংলাদেশ আমার পছন্দের জায়গা। এখানে থাকতে থাকতে আমাকে বাংলাদেশিই মনে হয়। কেউ আমাকে বিদেশি মনে করে না। পড়াশোনার পরিবেশ সুন্দর। অন্য শিক্ষার্থীরা সহজেই মিশতে পারেন।

ফারহা ভারতের কাশ্মীর থেকে এসেছে। বেসকারি বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। এ শিক্ষার্থী জানায়, ভারতের মেডিক্যাল কলেজগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজের টিউশন ফি অনেক কম। অনেকেই কাশ্মীর থেকে বাংলাদেশে পড়তে আসেন। আরেক শিক্ষার্থী আহমেদ জানান, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে ৪৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী আছে। বেশির ভাগই কাশ্মীর ও নেপালি।

বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন বিদেশি শিক্ষার্থী আছেন। এরা সবাই নেপালের অধিবাসী। এদের এক ফার্মেসি বিভাগ ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আনসারি। তিনি জানান, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে আসা সহজ হয়। সার্কভুক্ত রাষ্ট্রের জন্য কোটা আছে। আর এখানে তেমন একটা প্রতিযোগিতা হয় না এ জন্যই আসা। তবে এখানে পড়তে বেশ ভালোই লাগে। তা ছাড়া কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না।’ ফার্মেসি বিভাগ ৪৫তম ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী মো. শামস তাবরীজ বলেন, ‘বাবার স্বপ্ন ছিল আমি বাংলাদেশে পড়ব। আমার বাড়ির পাশের এক ভাই ছিলেন যিনি এখান থেকে পড়াশোনা করেছেন। তা ছাড়া এখানে পড়াশোনা একটু ভালো। এ জন্যই আসা। এখানে পড়তে কোনো সমস্যা হয় না। মোটামুটি নেপাল থেকে বাংলাদেশ একটু ভালো।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, দেশের মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তাদের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। আশা করছি, দিন দিন এ সংখ্যা আরো বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিক্ষার মান, আবাসনের সুবব্যস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তার কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার আগ্রহ বাড়ছে। পাশাপাশি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আবাসন সুবিধা, শিক্ষার মান বাড়ানো ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ভালো রয়েছে বলেই বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, বাংলাদেশে উন্নত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এ দেশে ঝুঁকছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, তুরস্ক, ইরান ও চীনের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। কারণ এখানে পড়াশোনার খরচ কম। পরিবেশ ভালো। স্বাছন্দ্য বোধ করে। মেডিক্যাল কলেজের তুলনায় সাধারণ বা টেকনিক্যাল শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ বেশি আসে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (মেডিক্যাল শিক্ষা এবং এইচএমপিডি) অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ বলেন প্রতি বছর বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় বিশেষ করে নেপাল, ভুটানের চেয়ে মেডিক্যাল শিক্ষার খরচ কম। বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ আছে, তারা বিদেশি শিক্ষার্থীদের বেশ আকৃষ্ট করতে পেরেছে। তাই তারা এখানে আসছেন।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: শিক্ষা

Leave A Reply

Your email address will not be published.