শুক্রবার ৬ বৈশাখ, ১৪৩১ ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ শুক্রবার

তরুণ কবি ফয়সাল হাবিব সানি’র এক গুচ্ছ কবিতা ‘নীলাবতী’

তরুণ কবি ফয়সাল হাবিব সানি’র অালোচিত নীলাবতী সিরিজের ১১ কবিতা

নীলাবতী-১

পৃথিবীও একদিন জেগে উঠলো প্রথম যৌনতায়
নারীহীন নারীর সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হলো ওই অাদিম পৃথিবী,
মৈথুন স্বার্থক হলো তাদের।
তারপর সেখান থেকে জন্ম নিলো পৃথিবীর এক সুন্দরী সুকন্যা, ভালোবেসে পৃথিবী তার নাম দিলো `বতী’।
এরপর বহু বহু বছর কেটে গেলো…
পৃথিবীর বুকে ছড়ালো নীলের অাভা, ঠোঁট দিয়ে ধ্রুপদী অাকাশের সব রঙ কিনে নিলো উদাত্ত পৃথিবী। অার কোনো একদিন পরম তৃষ্ণায় নীল পান করলো অাকাশের স্তন।
একদা নীলের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে অাবদ্ধ হলো `বতী’
তাদের গর্ভেও কন্যা সন্তান এলো, `নীল’ ও `বতী’র মিলনে ভূমিষ্ঠ এ সন্তানের নাম রাখা হলো `নীলাবতী’।
অতঃপর
নীলাবতীর গর্ভ হতে জন্ম নিতে থাকলো পৃথিবীর অাদ্যন্ত প্রেম…

পৃথিবীতে প্রেমের ইতিহাস ছিলো এমনই

নীলাবতী-২

কবি একদিন জোছনা কুড়াতে গেলো পৃথিবীর পথে
পৃথিবীর পথে যেতে যেতে নীলাবতীকে পেলো সে; যেন পৃথিবীর সব নীল শুষে নিলো কবি’র হৃদয়।
কিন্তু ছোঁবার অাগেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো নীলাবতী নীলকন্যা!
কবি’র অার জোছনা কুড়ানো হলো না।
পৃথিবীর সব জোছনারা ঝরে পড়লো কবি’র পায়ে
তারপর খেলো হামাগুড়ি;

অার নীলাবতী সর্বস্ব নিয়ে হামাগুড়ি খেতে থাকলো কবি’র সত্তায়, তারপর হলো ক্ষত-
অার অবশেষে সেখান থেকে প্রেম ইনফেকশান!

নীলাবতী-৩

পৃথিবীর সবচেয়ে সুগভীর জলপ্রপাত থেকে একদিন উঠে এলো নীলাবতী,
যেখানে মানুষের অবগাহন প্রায় দুঃসাধ্য!
স্নানরত নীলাবতীর শরীর বেয়ে যখন বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি ঝরছিলো তখন মনে হলো এ কোনো বৃষ্টি নয়,
পৃথিবীর সকল কান্না যেন নিমিষেই অাছড়ে পড়ছে মাটিতে।
অাজ পৃথিবীর সুখের দিন, বড্ড বেশি সুখের দিন…

পৃথিবীকে সুখপ্রপাতে ভাসিয়ে নীলাবতী অাবার অবগাহন করলো সেই জলপ্রপাতে;
তারপর-
জলের সাথে মিশে গেলো কোথায় যেন!
কবি’র চোখে এখন জলপ্রপাতের বিস্তৃত জলরাশি, নীলাবতী নয়
অার মুহূর্তেই কবি’র দু’চোখ দখল করেছে কেবলই কান্নার সুগভীর জলপ্রপাত!

নীলাবতী-৪

নীলাবতীকে নীল শাড়িতে বেজায় লাগতো
মুক্তার জন্মে যেমন কাঁদা মাখা অবহেলিত ঝিনুককে মনে হতো ঝলমলে অালোক পিদিম;
যদিও নীলাবতী ছিলো কবি’র দুর্লভ্য প্রেম
তারপরও যতোবার দেখেছি মনে হয়েছে, নীলাবতী নীল শাড়ি পড়ে ছোট ছোট পা ফেলে কখন যেন কবি’র অন্তরগৃহে ঢুকেছে
যেন নীল শাড়ি নয়, নীল জোছনার অাস্তরণে মোড়ানো চাঁদের শরীর তার!
ইচ্ছে থাকলেও কলম হাতে ওই দুঃসাধ্য চাঁদ ছোঁবার স্পর্ধা কখনোই জাগেনি কবি’র, জেগেছে কেবলই পৃথিবীর পথে পথে কেঁদে বেড়ানো অাজন্ম কি এক তৃষিত বঞ্চিত প্রেমের ক্ষুধা!

যে ক্ষুধা অাদ্যন্ত ক্ষুধিত করেছে কবিকে রাতের গহনে ফুটন্ত জোনাকির মতো,
যে জোনাকিরা রাতের তলদেশে জ্বলে জ্বলে পোঁকামাকড় খেয়ে তাদের অাহার মেটায়।
অার কবি তো চেয়েছিলো নীলাবতীর অালোয় জ্বলে সে-ও অাহার সঞ্চয় করতে যাবে…
কেবল নীলাবতীর প্রেমই হবে তার বেঁচে থাকার খাদ্য।

নীলাবতী-৫

কবি ছিলো বাংলার স্টুডেন্ট
তবুও কেনো জানি প্রত্নতত্ত্বের এক স্যার এসে প্রত্নতত্ত্ব অাবিষ্কারের গুরুভার তুলে দিলো কবি’র হাতে
অার কবি প্রত্নতত্ত্ব অাবিষ্কারের নিমিত্তে অাধা জল খেয়েই মাটি খনন করতে লেগে গেলো
কিন্তু কবি’র দুর্ভাগ্য মাটি খনন করে সেখানে কবি কোনো প্রত্নতত্ত্বের সন্ধান পেলো না; বরং সেখানে একত্রে কবি পড়ে পেলো অনেকগুলো প্রেম…
এবং
মাটি খনন করতে গিয়ে কবি ভুলবশত প্রেমের হৃদয় কেটে ফেললো খানিকটা!
প্রেমের হৃদয় কেটে গিয়েছিলো বলে কিঞ্চিত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রেমও একদিন খনন করলো কবি’র হৃদয়
অার অাশ্চর্য্যজনকভাবে কবি’র হৃদয় খনন করে প্রেম পেলো নীলাবতীকে!

কবি’র হৃদয়ে প্রথম `নীলাবতী’ অাবিষ্কৃত হয়েছিলো এভাবেই

নীলাবতী-৬

হালকা লিপস্টিক ঠোঁটে নীলাবতী যেদিন হাসি উড়িয়েছিলো কবি’র সফেদ অাকাশে
মনে হয়েছিলো, সে হাসির ব্যালকনিতেই জন্মেছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা।

কবিতা সে তো শাশ্বত, জীবনেরই অারেক নাম;
জীবনকে অামি তাই কখনো কখনো কবিতা নামেই ডাকি
অার নীলাবতীকে ডাকি `জীবন’ নামে
কবি’র জীবনের গভীরতর জীবনের পেটে যার পুরোধা অবস্থান…

নীলাবতী-৭

নিঃসঙ্গতার পেটে বসে এক থলে নীলাভ বিষণ্নতাকে জন্ম দিয়ে কবি সেদিন ভাবছিলো,
পানির ওপর কিভাবে স্রোত বয়ে যায়, চলে যায় গন্তব্যহীন…
প্রথম কবি যেদিন নীলাবতীর প্রেমে পড়েছিলো সেদিন মনে হয়েছিলো কবি’র,
তার রক্তের ওপর দিয়েও কি যেন বয়ে যায়…
তবে কবি জানতো, এর নাম `স্রোত’ নয়, অন্য কিছু; অন্য কিছু মানেই অন্য কিছু।
স্রোত হলে তো একসময় তা-ও থেমে যেতো, যুবতী সমুদ্র সে কথা জানতো, জানতো মানে হয়তো অারও কিছু জানতো!
কিন্তু কবি’র রক্তে প্রবহমান সে কিছু অার কখনোই থামেনি
শুধু বয়ে চলেছে তো চলেছেই…

সমুদ্রের সাথে হয়তো পার্থক্য ওইটুকুই কবি’র,
সমুদ্র স্রোত ধরে রাখতে পারে
কিন্তু কবি সে স্রোত ধরে রাখতে পারে না-
কবি’র অাবেগ তাই সমুদ্রকে ধরে রাখতে পারে
অার সমুদ্রের অাবেগ কখনোই কবিকে ধরে রাখতে পারে না
যেমনি কবি ধরে রাখতে পারে না নীলাবতীকে!

নীলাবতী-৮

কবি একদিন শূণ্যতা বেঁচতে গেলো পৃথিবীর বাজারে
কিন্তু শূণ্য মূল্যেও কেউ শূণ্যতা কিনলো না তার;
শূণ্যতা বেঁচতে গিয়ে অাককস্মিকভাবেই নীলাবতীর সাথে দেখা হলো কবি’র!
নীলাবতী রোদ্রস্নানে ভিজছিলো তখন! কবিকে দেখামাত্রই এক টুকরো হাসি ঠোঁটে ছড়াতে ছড়াতে বললো, সে-ও নাকি পৃথিবীর বাজারে শূণ্যতা বেঁচতে এসেছে
কিন্তু তাদের দু’জনেরই শূণ্যতা বিক্রি হলো না কোথাও!
অতঃপর-
তারা সিদ্ধান্ত নিলো
দু’জন দু’জনের কাছেই সমস্ত শূণ্যতা বেঁচে দেবে।

শূণ্যতা এভাবে বিক্রি হলো বৈ কি, কিন্তু শূণ্যতা শুধু শূণ্যতায় রয়ে গেলো
কেননা তারা একে অপরের কাছে শূণ্যতা বেঁচে সে তো শূণ্যতায় প্রদান করলো!

নীলাবতী-৯

অাকাশের বুকে ঝুলে থাকা ধ্রুবতাঁরাটি কতো সহজেই বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়লো একদিন
তারপর পৃথিবীর পদভারে ও পদাঘাতে দারুণভাবে দলিত হলো সে, কি সকরুণ অার্তি গভীর ভেতরে জমা ছিলো তার
সে কথা কবি জানে!
কবি জানে, পৃথিবীর পদভারে দলিত ওই ধ্রুবতাঁরাটি উঠে দাঁড়াতে চেয়েছিলো, অব্যক্ত বলতে চেয়েছিলো কিছু, কিছু তো বলতে চেয়েছিলো! তবু মাথা তুলে সদম্ভে উঠে অাকাশকে বলতে পারলো না সে ভালোবাসার কথা তার
যেমনি কবিও বলতে পারেনি নীলাবতীকে!
হয়তো এখন অাকাশ ও ধ্রুবতাঁরার দূরত্বই সৃষ্টি করেছে অারেক দূরত্ব, যে দূরত্বের সীমানা দূরত্বেরও অনেক ঊর্ধ্বে!

কবিও নীলাবতীকে দেখেছিলো সেদিন দূর থেকে, যতোটুকু মনে হয় হয়তো তারও অারও বেশি দূর থেকে…
কোনো এক অস্পষ্ট অবয়বে নীল শাড়ি কোমরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন কেউ, যুগ-যুগান্তর কার জন্য যেন দীর্ঘ অপেক্ষা তার, প্রতীক্ষা দীর্ঘ তাঁর!
তবে কবি জানেনা, এ অপেক্ষা নাকি প্রতীক্ষা নীলাবতীর, প্রতীক্ষা নাকি অপেক্ষা কারোর!
চোখের দূরত্ব হয়তো নীলাবতীকে দূরে রেখেছে কবি’র থেকে
কিন্তু মনের দূরত্ব সে তো নীলাবতীকে কাছে এনেছে অনেক বেশি, হয়তো কাছে পাবার থেকেও বেশি!
কেননা কবি জানে, চোখের দূরত্ব থেকে মনের দূরত্ব অধিক, অধিক মানে অারও অধিক, অারও বেশি অধিক…

নীলাবতী-১০

নীলাবতী কবে যেন এসেছিলো অার কবি’র সত্তায় বিষমভাবে সত্ত্যায়ন করেছিলো কিসে!
সময়ও জানে না সে কথা…
কবি’র বুকের ওপর পা তুলে যে সময় একদিন ভালোবাসা শিখিয়েছিলো নীলাবতীকে,
অাজ সে সময়ের চোখেই করুণ সময় কেবল ফেলনাময়!
অার কবি সে তো নীলাবতীকে হৃদয়নীলে পেতে চেয়েছিলো খুব নিকটে— যেখানে দূরত্ব ওইটুকুই যে দূরত্বে চুম্বক পেতে চেয়েছিলো এ পৃথিবীর অাদিম লোহাকে সর্বস্বতায়।
কবি তার রক্তের ভেতর অাবশ্যক অপরিহার্য উপাদানররূপে গ্রহণ করতে চেয়েছিলো নীলাবতীকে!

কিন্তু নীলাবতী সে কি কখনো নিজেকে কবি’র রক্তের ভেতর সমর্পণ করবে!
কবি’র রক্তে যে নীলাবতীর প্রবল শূণ্যতা, যে শূণ্যতা অাজ হিমোগ্লোবিনের থেকেও অত্যধিক…

নীলাবতী-১১

নীলাবতী জানো,
এ বৃষ্টি অামার খুব ভালো লাগে!
বৃষ্টির প্রতি ফোঁটার মধ্যে কোনো এক ফোঁটা যেন তুমি হয়ে ঝরো
অামি সে একটি `তুমি’ ফোঁটার প্রতীক্ষায় বৃষ্টিতে ভিজি, ভোরে ভিজি, সকালে ভিজি, দুপুরে ভিজি, অপরাহ্নে ভিজি, সন্ধ্যায় ভিজি, সারা নিশি, সারা নিশি মানে অন্তহীন ভিজি!
সদ্য দুরন্ত ষোড়শ কিশোরের মতো বড্ড বেশি ভিজি, এখন অামার ভিজতে খুব ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে মানে ভালোবাসা জাগে
হয়তো সে ভালো লাগা, ভালোবাসার উত্থান ও জন্ম তোমার জন্যই নীলাবতী!

তবে ইদানিং বৃষ্টিতে ভিজলে অামার খুব জ্বর হয়, সর্দি হয়, কাঁশি হয়, একদলা কফ মুখনিঃসৃত হয়
তবু জানি, এ অসুখ অামায় সইতে হবে! অামি যে শুধু সেই একটি ফোঁটার জন্য অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করে প্রতীক্ষা করি, প্রতীক্ষা করতে করতে কিছু করি, অন্তত কিছু তো একটা কিছু তো করি…
নীলাবতী,
ঊনিশটা বছর কেবল বছরে কাটিয়েছি, বছরে কাটানো মানে মানবহীন নয়, এভাবে কাটানো মানে নিঃসঙ্গতা, নিঃসঙ্গতা মানে একা, অারও একা অারও বেশি একা অারও!
একটি প্রশ্ন, তবে করলামঃ
`অাচ্ছা নীলাবতী,
তুমিও কি কখনো অামার জন্য কবি’র মতো বৃষ্টিতে ভিজেছো?’
ফয়সাল হাবিব সানি
তরুণ কবি ও সাংবাদিক, বাংলাদেশ।
`অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৬’- তে প্রকাশিত `দাবানল’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা।
স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষ (বাংলা বিভাগ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
ফেইসবুক অাইডি: Foysal Habib Sany
গুগল সার্চ: Foysal Habib Sany

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: সাহিত্য

Leave A Reply

Your email address will not be published.