মঙ্গলবার ৩ বৈশাখ, ১৪৩১ ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ মঙ্গলবার

চলন্ত বাসে তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা

বিষেরবাঁশী ডেস্ক: চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এক তরুণী কর্মীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। গত শুক্রবার তিনি বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাসে করে কর্মস্থল ময়মনসিংহে ফিরছিলেন। এ ঘটনায় টাঙ্গাইলের মধুপুর থানার পুলিশ বাসটির পাঁচ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের মধ্যে তিনজন গতকাল মঙ্গলবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বিগত বছরগুলোতেও বাসে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ পৈশাচিক এ ঘটনা দেশের সড়ক পরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে।

শুক্রবার রাতে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের পঁচিশ মাইল (মধুপুর বন) এলাকায় রাস্তার পাশ থেকে ওই তরুণীর লাশ অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের গায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে। গত সোমবার থানায় সংরক্ষিত লাশের ছবি দেখে বোনকে শনাক্ত করেন বড় ভাই। তাঁর কথার সূত্র ধরে পুলিশ ছোয়া পরিবহনের পাঁচ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা হলেন বাসচালক হাবিব (৪৫), সুপারভাইজার সফর আলী (৫৫), চালকের সহকারী শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীর (১৯)। আকরাম ও জাহাঙ্গীরের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। শামীমের বাড়ি মুক্তাগাছার নন্দীবাড়ি। হাবিব ও সফর আলীর বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর ওই তরুণীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে গতকাল বিকেলে টাঙ্গাইলের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম গোলাম কিবরিয়ার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আজ বুধবার হাবিব ও সফর আলীকে আদালতে হাজির করা হবে।

যেভাবে গ্রেপ্তার

শুক্রবার রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তরুণীর। তাঁর বড় ভাই বলেন, এরপর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। পরদিন শনিবারও কোনো খোঁজখবর না পেয়ে তিনি ময়মনসিংহে গিয়ে কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন, বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন। পরে মধুপুর বনাঞ্চলে তরুণীর লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে তিনি সোমবার সন্ধ্যায় মধুপুর থানায় যান, বোনকে শনাক্ত করেন।

ওই তরুণীর ভাইয়ের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে, শুক্রবার তাঁর বোন ময়মনসিংহের কর্মস্থল থেকে বগুড়ায় গিয়েছিলেন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে। পরীক্ষা শেষে সন্ধ্যা সাতটার দিকে আরেক সহকর্মীর সঙ্গে ছোঁয়া পরিবহনের বাসে করে রওনা হন। ওই সহকর্মীর গন্তব্য ছিল ঢাকা। রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার দিকে বাসটি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় এলে সহকর্মী নেমে যান। তাঁর কথার সূত্র ধরে সোমবার রাতেই মধুপুরের পুলিশ ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি জব্দ করে। এটি তখন বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছিল। ওই বাসের পাঁচ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁরা ঘটনা স্বীকার করেন। তবে ধর্ষণ এবং হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটানোর পরও তাঁদের কোনো বিকার নেই। হত্যাকাণ্ডের পরদিন থেকেই খুনিরা আবারও নিয়মিত বাস চালিয়েছেন, যাত্রী নিয়ে বগুড়া-ময়মনসিংহে যাতায়াত করেছেন।

জিজ্ঞাসাবাদ

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মধুপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ওই দিন তরুণী ছাড়াও বাসে পাঁচ-ছয়জন যাত্রী ছিল। অন্য সব যাত্রী সিরাজগঞ্জ মোড়, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্ত ও এলেঙ্গায় নেমে যায়। এরপর বাসটি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার কাছাকাছি এলে বাসের চালকের সহকারী শামীম তরুণীকে জোর করে পেছনের আসনে নিয়ে যান। এ সময় তরুণী তাঁর কাছে থাকা পাঁচ হাজার টাকা ও মুঠোফোন শামীমকে দিয়ে তাঁকে নির্যাতন না করতে হাতজোড় করে অনুরোধ করেন। কিন্তু শামীম কোনো কথাই শোনেননি। পরে শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর তাঁকে ধর্ষণ করেন। তিনি কান্নাকাটি ও চিৎকার করা শুরু করলে তাঁরা তিনজন মুখ চেপে ধরেন। একপর্যায়ে ঘাড় মটকে তাঁকে হত্যা করা হয়। পরে মধুপুর উপজেলা সদর অতিক্রম করে বন এলাকা শুরু হলে পঁচিশ মাইল এলাকায় রাস্তার পাশে লাশ ফেলে রেখে চলে যান তাঁরা।

সংগ্রামী জীবন

তরুণীর বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশে। স্বজনেরা বলেন, স্থানীয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করেন। পরে ঢাকার একটি কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে বছর খানেক আগে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে বিক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেন। এর মধ্যেই ঢাকার একটি আইন কলেজে এলএলবিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনাও করছেন।

অপেক্ষায় থাকা মা এখন পাগলপ্রায়

‘আমি এখনো বাসে আছি, বাসায় পৌঁছে তোমাকে জানাব।’ মায়ের সঙ্গে এই ছিল তরুণীর শেষ কথা। আশায় আশায় থাকার পর সোমবার সন্ধ্যায় মা জানলেন, তাঁর মেয়েকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল। সেই থেকে মা পাগলপ্রায়। মেয়েটি নিখোঁজের পর শনিবার থেকেই তাঁদের বাড়িতে নাওয়াখাওয়া একরকম বন্ধ। সোমবার সন্ধ্যায় হত্যার খবর পাওয়ার পর বাড়িতে কান্নার রোল নামে। তরুণীর মা কেবলই কাঁদছেন আর কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন।

শঙ্কা-উদ্বেগ

২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে ফিজিওথেরাপির ছাত্রী নির্ভয়াকে (ছদ্মনাম) চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ভারতজুড়ে প্রতিবাদ হয়। ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে শুভেচ্ছা পরিবহনের চলন্ত একটি বাসে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই মামলায় বাসচালক দিপু মিয়া ও চালকের সহযোগী কাশেম আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ২০১৫ সালের ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে ফেলে দেন বাসচালক ও চালকের সহকারী। ঢাকায় এক গারো তরুণীকে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি বরিশালে সেবা পরিবহনের একটি বাসে দুই বোনকে ধর্ষণ করে পাঁচ পরিবহনকর্মী। ওই বছরের ১ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী থেকে ঢাকাগামী বিনিময় পরিবহনের একটি বাসে ধর্ষণের শিকার হন এক পোশাককর্মী। পরে পুলিশ ওই বাসের তিন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি বাসে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে বাসচালকসহ তিন পরিবহনকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাসচালককে ঘটনাস্থল থেকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে জনগণ। সর্বশেষ এ ঘটনায় গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পরিবহন মালিকদের সংগঠন বাস-ট্রাক মালিক সমিতির চেয়ারম্যান ও সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার বলেন, ‘এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা পুরো পরিবহন খাত সম্পর্কে মানুষকে খুব নেতিবাচক ধারণা দেয়। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আমি বাসমালিকদের প্রতি অনুরোধ করব, নিজেদের গাড়ির কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর অতীত ইতিহাস ও পূর্বপরিচয় নিশ্চিত করে নিন। কারণ, কর্মীদের এসব ন্যক্কারজনক কাজের জন্য মালিকও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা প্রত্যেকেই কলঙ্কিত হব। এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে, সে জন্য সবাইকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: অপরাধ ও দুর্নীতি,সারাদেশ

Leave A Reply

Your email address will not be published.