বৃহস্পতিবার ৫ বৈশাখ, ১৪৩১ ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

‘গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় আমরা বাণিজ্যে অনেক পিছিয়ে’(শেষ পর্ব)

অনলাইন ডেস্ক:-দেশের স্বনামধন্য একটি রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান মাইক্রোফাইবার গ্রুপ। এ গ্রুপের একটি বড় খাত হচ্ছে গার্মেন্টস। ড. কামরুজ্জামান কায়সার এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের (অর্থ) দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দেশীয় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলসহ আন্তর্জাতিক অনেক মিডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলে থাকেন। দেশের অনেক টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতেও অংশ নেন।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারী ছড়িয়ে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ তার বাইরে থাকতে পারে নি। ফলে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে। গার্মেন্টস খাতে লাগে বড় ধাক্কা। কিন্তু এরইমাঝে বেড়েছে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং প্রবাসী আয়। করোনাভাইরাস দেশে অতটা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে না পড়লেও আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা, চড়াই-উৎরাইয়ের সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারটেক্স নিউজ দেশের অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতের বর্তমান অবস্থা, করোনায় ক্ষয়-ক্ষতি, আমাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা, গভীর সমুদ্রন্দর নির্মাণ প্রভৃতি নানা প্রাসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছে ড. কামরুজ্জামান কায়সারের সঙ্গে। দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে দেশের অর্থনীতির নানা চিত্র, নানা তথ্য। ভারটেক্স নিউজের পাঠকদের জন্য এখানে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। আজ উপস্থাপিত হলো শেষ পর্ব।

ভারটেক্স নিউজ: ড. কামরুজ্জামান কায়সার, নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যদিও চীনের পরেই আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান তবে এর মধ্যে ব্যবধান কিন্তু অনেক। চীন যেখানে ওয়ার্ল্ড মাকেটের শতকরা ৩৩ ভাগ দখল করে আছে সেখানে আমাদের দখলে মাত্র শতকরা ৯ ভাগ। এই ব্যবধান কমানো কী সম্ভব? এজন্য বাংলাদেশ কী করতে পারে?

 ড. কামরুজ্জামান কায়সার: যদিও আমরা বেশ ভালো অবস্থানে আছি, ছোট দেশ তারপরেও ওয়ার্ল্ড মার্কেটে নিটওয়্যারে আমরা সেকেন্ড পজিশনে আছি কিন্তু এটাই সবকিছু নয়। অন্যান্য আরো কয়েকটা ক্যাটাগরি আছে। ওভেন আছে, জিন্স আছে, সোয়েটার আছে, উলেন আছে। এইসব শিল্পে কিন্তু আমাদের অবস্থান এখনো প্রথম থেকে দশের মধ্যে নেই। এই যে ক্যাটাগরিগুলোর কথা বললাম, সেখানে আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের কাঁচামালের উৎস এবং ব্যাকইয়ার্ড লিংকেজটা ওভেন অ্যান্ড আদার্স সেক্টরে অতটা শক্তিশালী নয় যেটা আমরা নিটওয়্যারে শক্তিশালী করতে পরেছি। নিটওয়্যারের ক্ষেত্রে তুলোটাই শুধু আমাদেরকে বাইরে থেকে ইমপোর্ট করতে হয়। তারপরের যে স্টেজগুলো- ধরুন স্পিনিং, ডাইং, নিটিং, সুইং, কেমিক্যাল, অ্যাক্সেসরিজ এগুলো কিন্তু নিটওয়্যারের ক্ষেত্রে আমরা সুন্দরভাবে সাজিয়েছি, সুন্দরভাবে সিংক্রোনাইজ করতে পেরেছি। এগুলো করতে পেরেছি বলেই আজ আমরা ওয়ার্ল্ড মার্কেটে চায়নার পরে দ্বিতীয় অবস্থানে। আপনি যে কথাটি বললেন, আমরা এখনো সিঙ্গেল ডিজিট এক্সপোর্ট ফিগারে আছি। চায়নার থেকে আমাদের এক্সপোর্ট অনেক কম। স্বভাবতই কম হবে কিন্তু ব্যবধান অনেক বেশি। তাদের ওয়ার্ল্ড মার্কেট শেয়ার ৩৩ পার্সেন্ট, আমাদের ৯ পার্সেন্ট। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই ব্যবধানটা কমিয়ে আনার উপায় কী? উপায়টা হচ্ছে- আমরা মনে করি হয়ত আমরা অনেক দূর এগুতে পারব। এইজন্য এগুতে পারব যে, আমাদের কতগুলো টার্গেট আছে। ওই টার্গেটগুলো যদি আমরা ফিলআপ করতে পারি তাহলে আমরা বলতে পারব, আমরা স্যাচুরেটেড পয়েন্টে আছি; এর ওপরে আর যাওয়া সম্ভব না। আমরা এখনো ফিফটি পার্সেন্ট এফিশিয়েন্সিতে আছি। আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতা ৫০ পার্সেন্ট, যেখানে চায়নার দক্ষতা হলো ৭০ পার্সেন্ট। আমরা এই জায়গায়ই তো ২০ পার্সেন্ট পিছিয়ে আছি। তাদের উৎপাদন দক্ষতার দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে আছি বলেই এ ব্যবধানটা আছে।

আরেকটা হচ্ছে- কাঁচামালের দিক দিয়েও আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। সব কাঁচামাল আমাদের কাছে নেই, যেটা চায়নার আছে। আমাদের তুলো আনতে হয় বিদেশ থেকে- আফ্রিকা থেকে, সিআইএস কান্ট্রি থেকে ইভেন চায়না থেকেও। ফলে বেসিক যে ফ্যাক্টর সে জায়গায় তাদের থেকে আমরা অনেক পেছনে।

একটা বড় বিষয় হলো যে, বর্তমান সরকার, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে ১০টি অঞ্চলকে প্রায়োরিটি বেসিসে গার্মেন্টস শিল্পের জন্য দেয়া হয়েছে। কোস্টাল বা উপকূলীয় এরিয়াকে কেন্দ্র করেই কিন্তু অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রণয়ন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাইয়ে আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের বড় একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে যেখানে পুরেটাই গার্মেন্টস শিল্পভিত্তিক কলকারখানা থাকবে। খুলনাতেও সেভাবে গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। পায়রা বন্দরের আশপাশেও কিন্তু গার্মেন্ট শিল্পের কথা ভাবা হচ্ছে। এগুলো অনেক ভালো দিক এবং ওই যে, অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন যে শিল্পগুলো স্থাপিত হবে সেখানে অটোমেটিক টেকনোলজিগুলোকে স্থাপন করা হবে। সেখান মানুষের আধিক্যটা কমিয়ে পাশ্চাত্যের আদলে বা উন্নত দেশের আদলে আমাদের এই শিল্পগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন হয়ত আমরা আমাদের এফিশিয়েন্সি ও অটোমেশনকে আরো উন্নত করতে পারব এবং আমরা আমাদের প্রোডাকশনকে আরো বাড়িয়ে নিতে পারব। ৮ বিলিয়নের জায়গায় হয়ত আমরা ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার ইউএস ডলারেও আমরা চলে যেতে পারব। আর তখনই দেখা যাবে- চায়নার সঙ্গে আমাদের এখনকার ওয়ার্ল্ড মার্কেট শেয়ারিংয়ের যে ব্যবধানটা সেটা আরো কমে আসবে।

ভারটেক্স নিউজ: বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের আধুনিকায়নের অবস্থা কী? আমরা আসলে কোন পর্যায়ে আছি?

ড. কামরুজ্জামান কায়সার: আমাদের গার্মেন্টস খাতে এখনো সেভাবে আধুনিকায়ন হয় নি। অটোমেশন অনেক কম। আমাদের এখনো শ্রমঘন ইন্ডাস্ট্রি। এখানে ম্যানুয়াল অপারেশনটা অনেক বেশি। চায়নাতে ম্যানুয়াল অপারেশন অনেক কম। এটাকে আমাদের কমাতে হবে, আমাদের ম্যানুয়াল অপারেশন কমিয়ে অটোমেশনটা বাড়িয়ে দিতে হবে। আমরা এখন ২০ থেকে ২৫ পার্সেন্ট অটোমেশনে আছি, যেখানে চায়নাতে আছে প্রায় শতভাগ। তারপরে তারা রোবট কন্ট্রোলিং অপারেশন করে, আমরা কিন্তু এখনো মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়েই চলি। আমাদের যদি এখনো ২০ লাইনের গার্মেন্টসের একটা ইন্ডাস্ট্রি থাকে তাহলে একেকটা মেশিনের জন্য একেকটা অপারেটর, তারপরে দুটো করে হেল্পার, তারপর কিউসি। দেখা যাচ্ছে একটা মেশিনে অন অ্যান এভারেজ পাঁচজন করে মানুষ কাজ করে। কেন পাঁচজন করে মানুষ কাজ করবে? আমি যদি অটোমেশনে যেতে পারতাম, আমি যদি রোবট কন্ট্রোলিংয়ে যেতে পারতাম বা কাম্পিউটারাইজিং করতে পারতাম, সেখানে সেন্ট্রাল পয়েন্টে বসে ৮০ জন লোকের জায়গায় চারজন লোক দিয়ে সব কাজ করতে পারতাম। ২০টা মেশিনে আমার টোটাল অপারেশন করতে পারতাম। সেখানে আমার অনেক মজুরি কম লাগতো, আমার পারফেকশন বেড়ে যেত। কারণ আপনারা জানেন যে, মানুষ দ্বারা পরিচালিত অপারেশন আর মেশিন দ্বারা পরিচালিত অপারেশনের মধ্যে ডিফারেন্স আছে। যেখানে অটোমেশন সেখানে এফিশিয়েন্সি অটোমেটিক্যালি বেশি হবে। এই বিষয়গুলো থাকলে প্রোডাকশন বাড়তো, কোয়ালিটিও বাড়তো, আবার একটা ইউনিক ফর্মে থাকতো। সবকিছু মিলিয়ে আমরা ওই পর্যায়ে যেতে পারতাম।

ভারটেক্স নিউজ: ড. কায়সার, আপনি সাক্ষাৎকারের মাঝখানে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রসঙ্গ টেনেছেন এবং এর সঙ্গে গার্মেন্টস শিল্প ও দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। আপনি কী আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন আমাদের গার্মেন্টস শিল্প ও জাতীয় রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সঙ্গে এর সম্পর্কটা কোথায়?

ড. কায়সার: জ্বি আপনাকে ধন্যবাদ, খুবই সঙ্গত ও ভালো একটি ইস্যু আপনি তুলে ধরেছেন। এই ইস্যুটা নিয়ে কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছি। সরকারি পর্যায়ে, বেসরকারি পর্যায়ে সর্বত্রই যখন আমাদের রপ্তানির কথা আসে তখনই এ নিয়ে আমরা কথা বলে থাকি। শুধু গার্মেন্টেস পণ্য নয়, সব পণ্যের ক্ষেত্রেই গভীর সমুদ্র বন্দরের একটা বিরাট প্রয়োজনীয়তা আছে।  আপনারা জানেন যে, আমাদের দুটো সমুদ্রবন্দর। একটা হলো চট্টগ্রাম, আরেকটা হলো মংলা। তবে আমাদের এক্সপোর্ট ইমপোর্টের নাইনটি পার্সেন্ট হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সেখানে যে বিদেশি জাহাজগুলো ভিড়ে, যে কাঁচামালগুলো আমরা আমদানি করি, সেগুলো নিয়ে বিদেশি জাহাজ কিন্তু একবারে মেইন বন্দরের কাছাকাছি আসতে পারে না। গভীর সমুদ্রবন্দর যেসব দেশে আছে সেসব দেশের মেইন ফ্যাসিলিটিজ বলতে যে, বড় যে জাহাজগুলো তা সরাসরি বন্দরের কাছে চলে আসবে। সেখান থেকে ডাইরেক্টলি আনলোড করা হবে। আর আমাদের ক্ষেত্রে কী হয়- প্রায় ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে যে মেইন ভ্যাসেল- যেটাকে মাদার ভ্যাসেল বলা হয় সেটা ২০ কিলোমিটার দূরে থাকে আমাদের চট্ট্গ্রাম বন্দর থেকে। পরে ফিডার ভ্যাসেল যায়, গিয়ে সেখান থেকে খালাস করে পণ্যটা আমাদের সমুদ্র বন্দরে নিয়ে আসে। এখানে প্রায় ৮/১০ দিন নষ্ট নয়। ধরেন বড় শিপ চলে এসেছে এক তারিখে। আমি কিন্তু পোর্টে ১০ তারিখের আগে পাচ্ছি না। এখানেই ১০টা দিন নষ্ট হচ্ছে। ঠিক তেমনিভাবে আমরা যখন পণ্য রপ্তানি করি তখন আমাদের যে ফিডার ভ্যাসেল আছে সেটার মাধ্যমে আমাদের সমুদ্রবন্দরের সাথে যে টার্মিনাল আছে সেখান থেকে পণ্য মেইন শিপে স্থানান্তরিত হতেও এক সপ্তাহ সময় লাগে।  টোটাল আমাদের সেইলিং পিরিয়ড যদি হয় একমাস সেখানে সাত/আট দিন নষ্ট হয়ে গেল আমাদের অভ্যন্তরীণ এই লোডিং/আনলোডিং বা ট্রান্সফরমেশনে। এখানে যদি আমরা ডিপ সী পোর্ট এবং একদম পোর্টের সাথে লাগোয়া ফ্যাসিলিটিজ আমরা গড়ে তুলতে পারতাম, সেখানে বড় শিপগুলো এসে নোঙর করতে পারতো তাহলে কিন্তু আমাদের এই ৮/১০ দিন সময় নষ্ট হতো না। এইজন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ দাবিটা উঠে আসছে। এটা এইজন্য উঠে আসছে যে, আপনার লিড টাইম কমাতে হবে। আপনার পণ্য ভালো হলেই হবে না, বাইয়ার যদি বলে, কম্পিটিটিভ কান্ট্রি থেকে আমি ১৫ দিনে পণ্য পাচ্ছি আর তোমার কাছ থেকে পাচ্ছি এক মাস পরে। তাহলে কিন্তু মাল সস্তা হলেও, আমার পণ্য সস্তা হলেও তারা নেবে না। কারণ সাপ্লাই চেইনে তাদের অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাবে। আর আপনারা জানেন, ইউরোপ-আমেরিকাতে তাদের পণ্যগুলো সিজনভিত্তিক। সামার হলো তিন মাসের জন্য। আমাদের বাংলাদেশ থেকে তিন মাসে সে হয়ত তিনবার পণ্য নিতে পারলো। কিন্তু চায়না ও ভিয়েতনাম থেকে ছয়বার নিতে পারবে। তাহলে তার মার্কেটিং, তার যে বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা, তার যোগানটা যেখান থেকে বেশি পাবে, ডিম্যান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই যেখানে থেকে সে সুন্দরভাবে রোল করলে পারবে সে সেখানেই যাবে; দুই সেন্ট বেশি হলেও সে তার ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে পারবে। এই যে ডিপ সি পোর্ট, এর ফ্যাসলিটিজটা না থাকার কারণে আমরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। তবে আশার কথা হলো- আমাদের পায়রা সমুদ্রবন্দর, পটুয়াখালীতে নতুন সমুদ্রবন্দরের কাজ হচ্ছে। আশা করব আগামী দিনে এই বন্দর দিয়েই আমাদের এক্সপোর্টের একটা বড় অংশ যাবে। কারণ পদ্মা ব্রিজ যদি হয়ে যায় তাহলে ঢাকা থেকে পটুয়াখালী যেতে যে সময় লাগবে তা চিটাগাং থেকে আরো কম। চিটাগাং যেতে এখন সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় আমাদের অতিবাহিত করতে হয়; সেখানে আরো চার ঘণ্টায় পায়রা বন্দরে আমাদের পণ্য পাঠিয়ে দিয়ে সেখান থেকে রপ্তানি করতে পারব। আর পায়রা বন্দরকে ডিপ সী পোর্ট হিসেবে তৈরি করার জন্য সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা করব যে, অন্তত একটা যদি ভালোমানের আন্তর্জাতিক ডিপ সী পোর্ট হয় তাহলে আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খুব ভালোভাবে টিকে থাকব। 

এই পোর্ট ফ্যাসিলিটিজের জন্যই সিঙ্গাপুর অনেক এগিয়ে আছে। এই পোর্ট ফ্যাসিলিটিজের জন্যই আজকে হংকং ট্রেডিংয়ে অনেক এগিয়ে আছে। কেননা, তারা এই ডিপ সী পোর্টের ফ্যাসিলিটিজ, বহির্বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় ট্রেডিং কান্ট্রি এবং যারা বড় বড় এক্সপোর্টার, তাদেরকে দিচ্ছে। তাদের যে অঞ্চলভিত্তিক লিংকআপ, ইউরোপ থেকে যে পণ্যগুলো অস্ট্রেলিয়া বা নি‌উজিল্যান্ড বা প্যাসিফিক ওশেনিয়া অঞ্চলে পাঠাবে তারা কিন্তু সিঙ্গাপুরকে হাব হিসেবে ব্যবহার করছে। হাব হিসেবে ব্যহার করছে কেন? সিঙ্গাপুরে তো কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই। সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে ট্রেডিংয়ের ওপরে। ওয়ার্ল্ডের মধ্যে ওয়ান অব দ্যা বেস্ট ডিপ সী পোর্ট হলো সিঙ্গাপুর। তাদের ১০ তলা, ১৫ তলা বা ২০ তরা বিশিষ্ট বড় বড় যে জাহাজগুলো একদম রোড সংলগ্ন, সড়ক পথের পাশে এসে শিপটা নোঙর করছে। সাথে সাথে মালগুলো খালাস করছে। যখন লোড করছে তখন লাগছে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ ঘন্টা। তার মধ্যে লোডিং আনলোডিং করে সে সেলিং করে দিচ্ছে। কত সময় এবং অর্থ সে বাঁচিয়ে নিচ্ছে! এখানে তার বাড়তি কোনো ফিডার ভ্যাসেল লাগছে না। বাড়তি ঝামেলাও নেই, অর্থ ও সময়ের সাশ্রয় হচ্ছে। যেখানে ডিপ সী পোর্ট নেই সেখানে বাড়তি হ্যাসেল থাকে, বাড়তি সময় ও অর্থের প্রশ্ন থাকে। এজন্য যেখানে ডিপ সী পোর্ট নেই সেখান থেকে কেউ পণ্য নিতে উৎসাহিত হয় না। আমাদের যে পণ্যগুলো ওশেনিয়া অঞ্চলে যায় আমরা কিন্তু সিঙ্গপুরকেই প্রেফার করি। আমরা তাদেরকে একটা ট্যারিফ দিই। তারা দেখেন, শুধু সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করেই তাদের একটা বাড়তি ইনকাম হচ্ছে। একটা পোর্টকে সাজালে দেশের অর্থনীতি কত সুন্দরভাবে দাঁড়িয়ে যায়, দেশের অর্থনীতিতে কত প্রভাব পড়ে সিঙ্গাপুর কিন্তু আমাদের সামনে তার একটা মডেল কান্ট্রি হিসেবে আছে।

ভারটেক্স নিউজ: আমাদের দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে এবং হয়-হচ্ছে এমন একটা অবস্থা ছিল। বিষয়টি এখন কোন পর্যায়ে?  

ড. কায়সার: এটা আসলে একটা আলোচনাসাপেক্ষ বিষয় এবং গভীর একটা আলোচনারই সূত্রপাত আমি মনে করি। এটা ক্লিয়ার করতে হলে আরো অনেক জিও-পলিটিক্সের কথা এখানে চলে আসবে। আমাদের দেশী এবং আন্তর্জাতিক কিছু জিও-পলিটিক্স এখানে ইনভলভ রয়েছে। সে কারণে আমরা যেভাবে চাই- সেভাবে  হয়ত আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি নি। আপনারা জানেন যে, আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ চায়না, তারা কিন্তু অনেক আগে থেকেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে, জাপান এর আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। তাদের নিজস্ব অর্থায়নে তারা ডিপ সী পোর্ট করে সেখান থেকে টোল ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থা করে অতি অল্প সময়ে পোর্ট করে দেবে। পোর্ট করবে, পোর্ট থেকে যে রেভিনিউটা আসবে সেটা হয়ত তারা ২০/২৫ বছর নিয়ে তারা হয়ত পোর্ট আমাদের কাছে ছেড়ে দেবে- যে ফ্যাসিলিটিসটা শ্রীলঙ্কা নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর, হাম্বানটোটাকে পুরোপুরি ডিপ সী পোর্ট হিসেবে ঢেলে সাজিয়েছে চায়না। এখন চায়নার নিয়ন্ত্রণে কিন্তু হাম্বানটোটা আছে। সেখানে বিদেশী জাহাগুলো যে ট্যারিফ দেয় সেটা চায়না ভোগ করছে। আর শ্রীলঙ্কা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তাদেরকে সেই সুবিধাটুকু দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা চিন্তা করেছে, ২০ বছর এর মুনাফা আমি না-ই পেলাম কিন্তু দেশে তো একটা স্থায়ী শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি হলো, ২০ বছর পরে তো এর রেভিনিউ আমি নেবো। কিন্তু এর আনুষঙ্গিক অনেকগুলো ফ্যাসিলিটিজ শ্রীলঙ্কা ভোগ করছে। সেইরকমভাবে আমাদেরও বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রগুলো অফার দিয়েছিল কিন্তু আমরা রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও বৈশ্বিক কিছু অর্থনৈতিক চক্রের যে আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি যার কারণে আমরা ঈপ্সিত লক্ষ্যে অনেকদূর গিয়েও আবার কেন জানি কোনো একটা অদৃশ্য কারণে সে পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখছে না। আমার মনে হয় সবার আগে দেশের স্বার্থকে সমুন্ন করতে হবে। এটা বেশ স্পর্শকাতর বিষয়। কেউ চাইবে না আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, ভালো আত্মনির্ভরশীল একটা দেশ হিসেবে জেগে উঠি। এটা হয়ত অনেকে পছন্দের কারণ নাও হতে পারে। এটা হলো আমরা একটা অ্যাজামশান। এই অ্যাজামশানটা এমন হতে পারে- আমরা যদি একটা ডিপ সী পোর্ট করি তাহলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত ভাইব্রেন্ট অঞ্চল হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে পারব এবং আমরা অনেকদূর এগিয়ে যাব। আমাদের যে ওয়ার্ল্ড কোনেক্টিভিটি সেটা যদি আরো সুন্দর হয়ে যায় তাহলে আমাদের রেভিনিউ বাড়বে, অর্থনৈতিকভাবে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যাব। আমরা আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী দেশ হিসেবে দ্রুত আত্মপ্রকাশ করতে পারব- যেটা সিঙ্গাপুর করেছে, মালয়েশিয়া করেছে, কোরিয়ায় হয়েছে। তারাও তো তাদের এইসব অবকাঠামোকে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে নিয়েছে। কোনো কোনো দেশ আমাদের পরেও স্বাধীন হয়ে আমাদের চেয়ে অনেকদূর এগিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যে পলিসি তা ঢেলে সাজাতে হবে। সবার উপরে দেশ, দেশকে যদি আত্মনির্ভরশীল করে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিতে হয় তাহলে আমাদের আসলে জিও-পলিটিক্স হতে দূরে থেকে আমাদের একটু স্ট্রং লিডারশিপ অ্যাটিচিউড এখানে প্রয়োগ করতে হবে। আগে দেশের স্বার্থ; দেশের স্বার্থটাকে সমুন্নত করতে হলে যেভাবে আমাদের পলিসিটাকে এক্সিকিউট করা যায় দেশের স্বার্থে সেটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের ডিপ সী পোর্টের প্রয়োজনীয়তা অনেক আগে থেকেই ছিল। যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের ডিপ সী পোর্ট করার প্রয়োজনীয়তা ততই বাড়ছে। কারণ আমরা একটি রপ্তানিমুখী দেশ। আমাদের মেইন রপ্তানি পণ্য তৈরিপোষাক, পাটশিল্প, চামড়াশিল্প, সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যালস- এগুলো সবই কিন্তু সমুদ্রবন্দর দিয়েই আমাদেরকে রপ্তানি করতে হয়। সেক্ষেত্রে দেশের সমুদ্রবন্দরকে অনেক বেশি ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে আমি মনে করি, আমাদের যে সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন; আগামী দিনগুলোতে হয়ত তা বাস্তবায়িত হবে।

ভারটেক্স নিউজ: ড. কামরুজ্জামান কায়সার, দীর্ঘ সময় ধরে ভারটেক্স নিউজকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ড. কায়সার: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুেগুলোতে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

বিষেরবাঁশী.কম/ডেস্ক/আয়েশা

Categories: শীর্ষ সংবাদ

Leave A Reply

Your email address will not be published.