বিষেরবাঁশী ডেস্ক: ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের দায়ে দুই শ’ দিনের বেশি সময় ধরে কারাবন্দি থাকার পর ভারতের এক তরুণ চিকিৎসক মুক্তি পেয়েছেন।
৩৮ বছর বয়সী ওই শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কফিল খানের বিরুদ্ধে গত বছরের ডিসেম্বরে দেশটির বিতর্কিত নতুন নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনা করে শিক্ষার্থীদের একটি বৈঠকে বক্তৃতা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থীর উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতায় ডা. কফিল বলেন, যত ভয় দেখানোই হোক না কেন, আমরা ভীত হবো না। আমাদের যত দমন করা হোক না কেন, প্রতিবার আমরা জেগে উঠবো।
উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় এখন কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিতর্কিত নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এ প্রদেশের পুলিশ ডা. কফিল খানের জ্বালাময়ী বক্তৃতাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। এই বক্তৃতার প্রায় ৪৫ দিন পর এই শিশু বিশেষজ্ঞকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগে পুলিশ বলেছে, বৈঠকে উপস্থিত মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে উসকানি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অনৈক্য, শত্রুতা এবং বিদ্বেষ বৃদ্ধির চেষ্টা করেছেন।
এরই প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার এলাহাবাদের হাইকোর্ট পুলিশি অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, ডা. কফিল খান কোনও ধরনের বিদ্বেষ কিংবা সহিংসতা প্রচার করেননি। মঙ্গলবার মধ্যরাতে আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর কারামুক্ত হন তিনি। এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুজন বিচারক বলেছেন, ওই চিকিৎসক মূলত দেশের নাগরিকদের মধ্যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। চিকিৎসকের ভাই আদিল খান বলেন, কফিল খানকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে। এখন সে রাষ্ট্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
ডা. কফিল খান গত তিন বছরের বেশিরভাগ সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন। এর আগে দিল্লি থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরের গোর্খাপুরের সরকারি একটি হাসপাতালে কফিল খান কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালের আগস্টে এই হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলায় ৭০ জন শিশু মারা যায় বলে অভিযোগ ওঠে। পরে রোগীর স্বজনদের একটি মামলায় কফিল খানকে সাত মাস কারাগারে কাটাতে হয়। একই মামলায় ওই হাসপাতালের প্রধানসহ আরও ৮ কর্মীকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
প্রায় এক লাখ মার্কিন ডলারের বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় হাসপাতালের অক্সিজেন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় অক্সিজেন সংকটে শিশুদের বেশিরভাগ মারা যান। যদিও স্থানীয় সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত বছরের এপ্রিলে কফিল খানকে জামিন দেয় আদালত। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আদালত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ থেকে খালাস দেয়। কিন্তু এ ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের দুঃখপ্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাওয়া হয়নি। ডা. কফিল খানের সমর্থকরা বলছেন, সরকারের গাফিলতির বিষয়ে আলোচনা করায় তিনি টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।
অক্সিজেন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় অসুস্থ শিশুরা মারা যায়। সেই সময় অক্সিজেন সরবরাহ হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর তরল অক্সিজেন ট্যাংক এবং মজুদ করে রাখা ৫০টি সিলিন্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যায়। পরবর্তী ৫৪ ঘণ্টায় ডা. কফিল খান হন্যে হয়ে কয়েক ডজন সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন।
নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ তুলে বিভিন্ন হাসপাতাল, দোকান ও আধা-সামরিক বাহিনীর ব্যারাকে যান অক্সিজেন সংগ্রহ করার জন্য। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন আধা-সামরিক বাহিনীর এক ডজন সদস্য। এর দুদিন পর ওই হাসপাতালে অক্সিজেনের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় ডা. কফিল খান পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে গিয়ে অক্সিজেন চেয়ে অনুরোধ করছেন। তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি আড়াই শ’ সিলিন্ডার সংগ্রহ করেছিলাম! ২৫০! আমি জানি না কতজন শিশু মারা গেছে অথবা বেঁচেছে। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।
করোনাভাইরাস মহামারির সময় কারাবন্দি কফিল খান দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, আমি একজন চিকিৎসক। এই মহামারি মোকাবিলায় আমাদের আরও অনেক চিকিৎসক দরকার। দয়া করে আমাকে মুক্ত করুন। রোগটি কমিয়ে আনতে আমি কিছুটা সহায়তা করতে পারবো বলে মনি করি।
এদিকে ডা. কফিল খানকে নিয়ে ভারতের মেরুকরণ শুরু হয়েছে। তার সমর্থকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় নিপীড়নের জীবন্ত উদাহরণ ডা. খান।
এই চিকিৎসকের একজন সহকর্মী বলেন, তিনি একজন যোদ্ধা। বর্তমানে তিনি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি শতাধিক মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করেছেন; যেখানে শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার অনেক আগে থেকে তিনি বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করে আসছেন। দেশটির হাজার হাজার মানুষ তার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশও করেছেন।
ডা. খান বর্তমানে রাজস্থান প্রদেশের জয়পুরের একটি সরকারি গেস্ট হাউসে রয়েছেন। দন্ত্য চিকিৎসক স্ত্রী, চার বছরের কন্যা ও দেড় বছরের ছেলে সন্তান সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়