শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

সাগর-রুনি হত্যার ৮ বছর র‌্যাবের কাছ থেকে এফবিআইয়ের ডিএনএ রিপোর্ট উধাও

বিষেরবাঁশি.কম: আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ডের আট বছরেও হত্যা মামলার তদন্তের কোন কুল কিনারা করতে পারেনি র‌্যাব। তারিখের পর তারিখ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন প্রায় ৭১ বার পেছানো হয়েছে। এভাবে কেবল তদন্তের নামে দীর্ঘ সময় ক্ষেপন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন সাংবাদিক নেতারা। কারা, কি উদ্দেশ্যে তাদের এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছে তা আজও অজানা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ৮ বছর হয়ে গেলো। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বৃত্তদের চারটি ডিএনএ মধ্যে দু’টি মিলেছে। এ দু’টিতে আসামিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। সেগুলো ফের যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইর ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ওই রিপোর্ট পাওয়া গেলে আসামীদের সনাক্ত সহজ হবে। মুলত ডিএনএ টেষ্ট মিললেই এই হত্যাকান্ডের মুল রহস্য উদঘাটন হবে বলে র‌্যাব বছরের পর বছর ধরে দাবি করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের ল্যাবের কাছ থেকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা রিপোর্ট এখনও র‌্যাবে আদালতে পূর্ণাঙ্গভাবে দাখিল করেনি। এ নিয়ে আদালতের কাছে র‌্যাব প্রতিবারই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। এটা নিয়ে নিহতের পরিবার ও সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সাংবাদিক নেতারা দাবি করছেন, র‌্যাবের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনার রিপোর্ট উধাও হয়ে গেছে। এই ডিএনএ নমুনা রিপোর্ট নিয়ে র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারা কেউই গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন না। এদিকে ছেলে ও পুত্রবধূ হত্যা মামলার তদন্তের শেষ দেখতে আট বছর অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে পড়েছেন সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির। এখনও তদন্তের কোনো সুরাহা না হওয়ায় এই হত্যা মামলায় যারা আটক হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। তদন্তকারীরা বলেন, মূলত কোনো হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেমে তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে হত্যাকান্ডের পেছনের কারণ খোঁজেন। এরপর আসামি শনাক্তকরণের চেষ্টা করেন, কোনো ধরনের ক্লু পেতে জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তির খোয়া যাওয়া মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন। এসব একটি মামলা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম, ৮ বছর তদন্তের পরও সাগর-রুনি হত্যা মামলা ঠিক এরুপ প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। এখনো আসামি শনাক্তকরণ, জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও নিহতদের খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছে তদন্ত সংস্থা। এদিকে গতকাল এই মামলার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে নির্ধা‌রিত দিনে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম। তাই ঢাকার মে‌ট্রোপ‌লিটন ম্যা‌জি‌স্ট্র্রেট দেবব্রত বিশ্বাস প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ফের ২৩ মার্চ দিন ধার্য করেছেন। এ নি‌য়ে প্র‌তি‌বেদন দা‌খি‌লের তা‌রিখ ৭১ বার পেছালো। এবিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম বলেন, গতকাল প্রতিবেদন দেইনি, আরও সময় লাগবে। তিনি বলেন, সময় চেয়েছি। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কোর্ট কতো তারিখ ধার্য করেছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা তো কোর্ট সিদ্ধান্ত দিবে, কোর্টের সিদ্ধান্ত এখনো পাইনি। প্রতিবেদন দাখিল করতে বিলম্ব হচ্ছে কেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, আসামি শনাক্তকরণ হয়নি, এ কারণে দেরি হচ্ছে। হত্যাকান্ডে সন্দেহভাজন ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকান্ডের সঙ্গে কে কে জড়িত? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটি আমার জানা নেই। তবে এ ঘটনায় ৬ জন কারাগারে রয়েছে। চলতি বছরে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব কিনা, তাও নিশ্চিত নন তিনি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, তিনি গত মে মাসে মামলার দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই মামলাটি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানেন না। তবে মামলার তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই বলেও জানান তিনি। র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম সে‌দিন উচ্চ আদালতকে জানান, তদন্তে কোনো ক্লু (সূত্র) পাওয়া যায়নি। চারটি ডিএনএ প্রতিবেদনের মধ্যে দু’টি মিলেছে। এ দু’টিতে আসামিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে সেগুলো ফের যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইর ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরের দিন রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। তবে এর দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র‌্যাবকে। সেই থেকে ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি। তবে এর আগে দাখিল করা প্রতিবেদনে ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বলা হলেও চুরি যাওয়া ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বটি, ছুরির বাট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে। এর আগে ৫৫ তম প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুইজন পুরুষের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রফাইল পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃত ৮আসামি, নিহত দুইজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত ৮জনের মধ্যে পাঁচজন- রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীর। এদের মধ্যে তানভীর, মিন্টু ও পলাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছে। ঢিলেঢালাভাবে তদন্ত চলায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতদের পরিবার। মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তো আদালতকে একটা কিছু জানাবেন। কিন্তু কোনো ফলোআপই জানাচ্ছেন না, আগ্রগতিই নাই। বরং বার বার সময় নিচ্ছেন, সর্বশেষ গতকালও সময় চেয়েছেন। আদালতও যেখানে বার বার সময় দিচ্ছেন, সেখানে আমাদের আর কি বলার আছে! সাগর-রুনির হত্যার বিচার চেয়ে আজ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ বলেন, ‘আমরা এ হত্যার বিচার চাই। কেনইবা এই হত্যার তদন্ত নিয়ে তালবাহানা করা হচ্ছে- সেটা আমরা জানতে চাই।’ বিষেরবাঁশি.কম/রাসেদ উদ্দীন ফয়সাল/মৌ দাস

Categories: অপরাধ ও দুর্নীতি,জাতীয়

Leave A Reply

Your email address will not be published.