লোমহর্ষক খুনের বর্ণনা প্রকাশ: ফল কাটা ছুরি দিয়ে দুই নারীকে হত্যা করা হয়
অনলাইন ডেস্ক: ধানমন্ডিতে জোড়া খুনের আসামি গৃহকর্মী সুরভী আক্তার নাহিদা (২২) লোমহর্ষক খুনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ’জীবনের প্রথম দিন গৃহকর্মী হিসাবে যোগ দিয়ে গৃহকর্ত্রীকে তার পছন্দ হয়নি। বাইরে যেতে চাইলে গৃহকর্ত্রী ফ্ল্যাটে ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে দেন। এরপর বকাঝকা করার কারণে আপেল কাটা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পুরাতন গৃহকর্মীর ওপর। এসময় গৃহকর্ত্রী ফোনে বিষয়টি জানাতে গেলে পিছন থেকে তাকেও ছুরি দিয়ে পোঁচ দেন। এরপর গৃহকর্ত্রীর মৃত্যু নিশ্চিত করে দরজার তালা খুলে পালিয়ে যান।’
শুক্রবার রাতে পুলিশ ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগম ও তার গৃহকর্মী দিতির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগমের মেয়ে দিলরুবা সুলতানা রুবা বাদী হয়ে ৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামীরা হলেন, আতিকুল হক বাচ্চু, অজ্ঞাতনামা ওই গৃহকর্মী, কেয়ারটেকার নুরুজ্জামান, কেয়ারটেকার বেলাল ও ক্লিনার রুমান।
ঘটনার পর আসামি সুরভী পালিয়ে আগারগাঁও বিএনপির বস্তিতে তার বোনের কাছে আশ্রয় নেন। গত রবিবার রাতে ধানমন্ডি থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সুরভী প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের তদন্তকারীদের জানিয়েছেন যে, ওই ঘটনার সঙ্গে সে একাই জড়িত। তিনি একাই এই দুই হত্যাকান্ড চালিয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে, এ ঘটনার সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর জামাতার গাড়ি চালক আতিকুল হক বাচ্চু ও বাড়ির সামনের পান দোকানি সুমন জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
সুরভী পুলিশকে জানান, ৩ বছর আগে নিহত আফরোজার বাসার পাশের পানের দোকানদার সুমনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মানসিক ও শারিরীক সম্পর্ক গড়ে উঠে। শেরেবাংলানগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে পর্যন্ত পড়ার পর তার আর পড়াশোনা হয়নি। বেকার থাকায় ঢাকার একটি শপিংমলে তিনি ক্লিনার হিসাবে কাজ শুরু করেন। এমনকি মিরপুরের একটি গার্মেন্টসে তিনি কাজ নেন। কিন্তু মানসিক অশান্তি থাকার কারণে তিনি ওই চাকরি করেনি। সুরভী তার বড় বোনকে নিয়ে আগারগাঁও বিএনপির বস্তিতে ভাড়া থাকতেন।
সংসারে টানাপোড়েনের কারণে একদিন ওই পান দোকানি সুমনকে সুরভী জানান যে, যেকোন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতে তিনি রাজি আছেন। ওই পান দোকানির কাছে পান খেতেন নিহতের জামাতার গাড়ি চালক বাচ্চু। বাচ্চু তার মালিকের বাসায় একজন কাজের মেয়ে লাগবে সুমনকে বিষয়টি জানালে সুমনের মাধ্যমে ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসাবে তিনি যোগ দেন।
সুরভী তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন যে, শুক্রবার দুপুরে তিনি কাজে যোগ দেয়ার জন্য ওই বাসায় যান। দুপুরে গিয়ে তিনি ওই বাসার কাপড় ধুয়ে দেন। দুপুরে তিনি ভাতও খেয়েছেন। বিকাল ৪ টার দিকে ঘরের কাজ শেষ করে এক পর্যায়ে তিনি বাইরে যেতে চান। কিন্তু আফরোজা বেগম তাকে ঘরের বাইরে বের হতে দেননি। আফরোজা বেগম তাকে জানান যে, তাকে বাসার বাইরে যাওয়া নিষেধ। যে তাকে বাসায় কাজ পাইয়ে দিয়েছেন সে আসলে যেতে পারবেন। আফরোজা ও অন্য কাজের মেয়ে দিতি মূল গেটে তালা লক করে দেন।
গ্রেপ্তার হওয়া সুরভী তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছেন যে, তাকে বাসার বাইরে না যেতে দেয়ার কারণে সে ফ্ল্যাটে ভয় পাচ্ছিলো। তাকে পাচার কিংবা অন্য কোনো অনৈতিক কাজে জড়ানো হয় কী-না তার মধ্যে সন্দেহের দানা বেঁধে উঠে।
বাচ্চুকে তিনি একাধিকবার ফোন দেয়ার পরও ধরেননি। এমনকি তার কিছুক্ষণ পরে বাচ্চুর ফোনটিও তিনি বন্ধ পান। এতে তিনি মানসিক টেনশনে পড়েন। বিকাল সাড়ে ৪ টার দিকে ফ্ল্যাটের মূল ফটক দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করলে দরজা লক করা দেখেন। ওইসময় তিনি গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগমের কাছে তিনি ফ্ল্যাটের চাবি চান। কিন্তু আফরোজা তাকে চাবি না দিয়ে বকাঝকা করেন। রাগারাগি করে তিনি দরজায় ঝাঁকি দেন। এসময় আফরোজা তাকে গালে একটি চড় মারেন। তখন কান্নারত অবস্থায় সুরভী ফ্ল্যাটের অন্যকক্ষে চলে যান।
সুরভী বলেন, একপর্যায়ে ওই বাসা থেকে তিনি পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে বাড়ির গৃহকর্ত্রী ও অন্য গৃহকর্মী বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বিকালে গৃহকর্মী দিতি ঘর ঝাড়– দেয়ার সময় পেছন থেকে আপেল কাটা ছুরি দিয়ে তার পিঠে পোঁচ দেন সুরভী। একপর্যায়ে তার গলায় পোঁচ দেন। এসময় তিনি (দিতি) চিৎকার দিয়ে মেঝেতে পড়ে যান। পিঠে ও গলায় আঘাত লাগার কারণে গোটা মেঝে রক্তে লাল হয়ে যায়। তার চিৎকার শুনে আফরোজা চিৎকার করা শুরু করেন। ফ্ল্যাটের তালা খোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু, এতে বাঁধা দেন সুরভী। এসময় দুইজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হলে আফরোজা রুমে গিয়ে মোবাইল হাতে নেয়া মাত্রই সুরভী ছুরি দিয়ে তার গলায় আঘাত করেন। পরপর দুইবার আঘাত করেন। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দুইজনের লাশ দুই বেডরুমে রেখে দেন। তার হাত ও পা রক্তে লাল হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি বাথরুমে পানি দিয়ে তা ধুয়ে ফ্ল্যাটের তালা খুলে আগারগাঁওয়ের বস্তিতে তিনি চলে যান। এ ঘটনায় তিনি উত্তপ্ত নন এবং ওই বাসা থেকেও তিনি কোন জিনিস নেননি বলেও দাবি করেন। সুরভীর গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার সদর থানার ইলিশাবাড়ি এলাকায়। তার বাবা পেশায় কৃষক।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন গত সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে জানান, ‘খুনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে পলাতক সুরভীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওই ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত এবং দুইজনকে গলাকেটে হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কী-না তা আমরা খতিয়ে দেখছি। বাসায় কাজের সমস্যাকে কেন্দ্র করে ওই ডাবল মার্ডারের ঘটনা ঘটেছে।’
বিষেরবাঁশি.কম/ডেস্ক/মৌ দাস/আহসান শিপু
Categories: অপরাধ ও দুর্নীতি,সারাদেশ