ক্যাসিনোর টাকায় মামুনকে বিএমডাব্লিউ গাড়ি উপহার দিয়েছেন
অনলাইন ডেস্ক: গুলশান-২ নম্বরে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সেলিম প্রধানের বাড়ির নিচতলায় এক সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনের ক্যাসিনো থেকে অর্জিত টাকার একটি অংশ লন্ডনে যেত বলে স্বীকার করেছেন গ্রেফতারকৃত সেলিম প্রধান। লন্ডনে কার কাছে এই টাকা যেত, সেটি জানতে চলছে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম।
গুলশানে সেলিমের বাড়ি ও অফিসে অভিযানের বিষয়ে র্যাব-১ অধিনায়ক বলেন, সেলিম বর্তমানে কারাগারে থাকা ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ক্লোজ ফ্রেন্ড (ঘনিষ্ঠ) ছিলেন। তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। মামুনের অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া সেলিম বিভিন্ন সময় লন্ডনে টাকা পাঠিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আমরা তাকে গ্রেফতার করি। তার বাসা ও অফিসে দুই জায়গায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪৮টি বিদেশি মদের বোতল, ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ নগদ টাকা, ২৩টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা যার মূল্য ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা, ১২টি পাসপোর্ট, ১২টি ব্যাংকের ৩২টি চেকবই, একটি বড় সার্ভার, ৪টি ল্যাপটপ এবং দু’টি হরিণের চামড়া উদ্ধার করেছে র্যাব।
লন্ডনে তিনি কাকে টাকা পাঠাতেন? গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের অধিনায়ক বলেন, ‘লন্ডনে কোথায় পাঠাতেন, সমীক্ষা করে জানাব।’ এই দুই অভিযানের বিষয়ে সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল আছে। এতে দেখতে পাই, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো গেমিংয়ে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। সোমবার আমরা জানতে পারি, এটার প্রধান সমন্বয়ক বা দলনেতা সেলিম প্রধান বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছিলেন। আমরা তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে বিমান থেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হই এবং প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার বাসা ও অফিসে অবস্থান নেই। সারারাত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিভিন্ন জিনিসপত্র পেয়েছি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হচ্ছে।
র্যাব অধিনায়ক বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম র্যাবকে জানান, তার জন্ম ১৯৭৩ সালে, ঢাকায়। ১৯৮৮ সালে ভাইয়ের মাধ্যমে জাপানে গিয়ে জাপানিজদের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসায় নিয়োজিত হন। পরে জাপানিদের সঙ্গে থাইল্যান্ড গিয়ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ব্যবসা করেন। পরে মি. দু নামের এক কোরীয় ব্যক্তি তাকে অনলাইন ক্যাসিনো খোলার উপদেশ দেন। এর ফলে তিনি ২০১৮ সালের পি-২৪ এবং টি-২১ হিসেবে দুটি গেমিং সাইট খোলেন। সেখান থেকে তিনি অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন। তার কাগজপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, ওই কোরীয় ও সেলিমের অর্ধেক অর্ধেক অনুপাতে লাভ ভাগের চুক্তি হয়েছিল।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘এটা ভার্চুয়াল ক্যাসিনো। আপনারা এতদিন মাঠে ক্যাসিনো বোর্ড দেখেছেন। এগুলো অনলাইনে খেলা হচ্ছে। অনলাইনে টাকা দিয়ে এগুলো খেলতে হয়। ধরেন, একটি মোবাইলে আপনি একটা সফটওয়্যার ইনস্টল করলেন (পি-২৪)। এগুলো খেলতে হলে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এটি ভিসা, মাস্টার কার্ড, বিকাশ বা নগদের হতে পারে। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রেখে এটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কেউ টাকা জিতলে নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। হারলে টাকাগুলো একটি গেটওয়ের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে যেত। সপ্তাহে একদিন সব টাকা এক ব্যাংকে দেয়া হত। সারওয়ার বিন কাশেম জানান, এখন পর্যন্ত এমন তিনটি ব্যাংকের নাম জানতে পেরেছে র্যাব।
ব্যাংকগুলো হলো যমুনা ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সিলং ব্যাংক। অ্যাকাউন্টগুলোয় নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখতে হতো। খেলায় জিতলে বা হারলে ওই অ্যাকাউন্টে টাকা যোগ হতো বা কাটা যেত। সম্পূর্ণ লেনদেন হতো একটি গেটওয়ের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত একটি গেটওয়েরই সন্ধান পেয়েছে র্যাব। সন্ধান পাওয়া ওই গেটওয়েতে কেবল এক মাসেই প্রায় নয় কোটি টাকা জমা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আরও গেটওয়ে আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সেলিমের দুই সহযোগী আখতারুজ্জামান ও রোকন লেনদেনের এই টাকা হয় নগদে তুলে নিতেন, নয়তো বিদেশে পাঠিয়ে দিতেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তার সহযোগী আক্তারুজ্জামান ও রোকনকেও গ্রেফতার করেছি। আক্তারুজ্জামান তার গেমিং সাইটটি চালাত এবং টাকা সংগ্রহ করে অন্য ব্যাংকে জমা করত। এরপর কোরীয় নাগরিক এসে এই টাকাগুলোর ভাগ নিয়ে যেত। এটি সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনের লঙ্ঘন। তাই তাকে চারটি অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথমত মানি লন্ডারিং, মাদকদ্রব্য, ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন।’ তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হরিনের চামড়া উদ্ধারের ঘটনায় তাকে ও তার সহযোগীদের ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত।
র্যাব সূত্র জানায়, অনলাইনে বিশ্বের সুপরিচিত ক্যাসিনোগুলোর সঙ্গে জুয়াড়িদের যুক্ত করার কাজ করতেন সেলিম। তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘প্রধান গ্রুপ’-এর কর্ণধার। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেড, পি২৪ ল ফার্ম, এইউ এন্টারটেইনমেন্ট, পি২৪ গেমিং, প্রধান হাউস ও প্রধান ম্যাগাজিন। এর মধ্যে পি২৪ গেমিংয়ের মাধ্যমে তিনি জুয়াড়িদের যুক্ত করতেন।
জানা গেছে, সেলিম প্রধানের সঙ্গে আর্থিক খাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সেলিম প্রধানের জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারসে বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ছাপা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিসের নথিপত্রও ছাপানো হয়। তার এই প্রতিষ্ঠান রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের একটি। ২০১৮ সালে ঋণটি পুনঃ তফসিল করা হয়। সেলিমের কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে, টেন্ডারবাজি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে সেলিম প্রধানের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
বিষেরবাঁশি.কম/ডেস্ক/মৌ দাস.
Categories: অপরাধ ও দুর্নীতি,সারাদেশ