- জুলফিকার আলি মাণিক
বাড়িতে অতিথি। আড্ডা-খাওয়া চলছে। বাড়ির ছোট শিশুসন্তান কথা প্রসঙ্গে বলে বসল, ‘মা খুব রাগী। আমাকে খালি বকে আর মারে।’ অতিথিরা অস্বস্তিতে। বিব্রত মা রেগে বললেন, ‘অ্যাই চুপ। সব মিথ্যা, বাজে কথা।’ শিশুটি থামল না- ‘তুমি রেগে গেলে তো গালিও দাও। লাঠি দিয়ে মার, এই যে হাতে একটা মারের দাগ এখনও আছে।’ ছোটর সঙ্গে সুর মেলালো আরেক সন্তান, ‘মা তো স্কুল থেকে আনার সময় আমাকে রাস্তায়ও মেরেছে। সব সময় বলে, আমরা খারাপ, অন্য বাচ্চারা ভালো।’ এবার মা ক্রুদ্ধ- ‘আমি শুধু মারি আর বকি? যাক সবাই, তারপর বুঝাবো মাইর কাকে বলে।’ অতিথিদের কাছে ছোট সন্তানের আকুতি- ‘মাকে বলেন না- যেন না মারে, গালি না দেয়।’
সমাজের বহু পরিবারেই এমন ঘটে। সেই ক্ষুদ্র বাস্তবতা হঠাৎ যেন বৃহৎ ক্যানভাসে তুলে আনলেন প্রিয়া সাহা। ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যান। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেখা পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বলেন বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনিরাপদ জীবন ও নির্যাতনের কথা। নিজের ভূ-সম্পত্তি বেদখলের কথাও বলেন। এতে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভীষণ চটে গেছে। ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে আরও সংগঠন এবং বিশিষ্ট ও সাধারণ নাগরিকরা। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আর তাদের শত্রু দল জামায়াতে ইসলামীর সুর মিলে গেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগ প্রিয়ার বক্তব্যকে ‘পুরোপুরি মিথ্যা’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘ষড়যন্ত্রমূলক’, ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ বলেছে। ক্ষুব্ধ সবাই প্রিয়ার বিচার ও শাস্তি চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপত্তি না করলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার রেকর্ড হয়ে যেত হয়তো এতক্ষণে। তা না হলেও ব্যক্তিগত বহু আক্রোশের রূপ ভয়াবহ। ধারালো রামদা হাতে জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমের ‘খুনে’ চেহারার ছবি একজন ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন- প্রিয়া সাহাকে ‘আইনের আওতায় এনে জবাই করা হোক।’ দাবিকারী ছাত্রলীগের একটি উপজেলা শাখার ‘উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক।’
বাংলাদেশের মতো অস্থির, অসহিষ্ণু, হুজুগে, লোভাতুর, ক্রোধে নিমজ্জিত সাম্প্রদায়িক, হিংসা, বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক সমাজের নাগরিক প্রিয়া সাহা একজন নারী; তার ওপর হিন্দু ধর্মাবলম্বী। স্বাভাবিকভাবেই আক্রমণের সহজতর লক্ষ্যবস্তু; বাদ যাননি তার স্বামী ও দুই কন্যাও। হিন্দু ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। তাই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নির্যাতনের শিকার হয়- এসব পুরনো প্রচলিত কথা। সেই হিসেবে প্রিয়ার আওয়ামী লীগের ভোটার হওয়া স্বাভাবিক। তিনিও এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, শেখ হাসিনা তার অনুপ্রেরণা। সেই আওয়ামী লীগ শিবিরের লোকেরাই নিঃসংকোচে প্রকাশ্যে তার প্রাণঘাতী সাজা চাইছে। চাপাতির কোপে জবাই করে মানুষ হত্যা দেশে গা-সহা ঘটনা। আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত কয়েক বছরেই ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা এমন করে অর্ধশতাধিক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েও হত্যা করা হয়েছে তাদের কাউকে কাউকে। হুমকি পেয়ে পুলিশের সাহায্য চেয়ে উল্টো দেশ ছাড়ার পরামর্শ পেয়েছেন, এমন উদাহরণও আছে। বাস্তবতা প্রতিকূল বুঝে নীরবে দেশ ছেড়ে গেছেন কত ব্লগার, লেখক, প্রকাশক; সে হিসাব কি আমরা রেখেছি? নিরুদ্দেশ হওয়া সেসব নাগরিকের সংখ্যা সরকার বা বেসরকারি কেউ দিতে পারবে না। তাই যার যা সংখ্যা জানা বা অনুমান হয়, সে তা-ই বলবে। প্রিয়া সাহাও এমন একটি সংখ্যা ট্রাম্পকে বলে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ‘৩৭ মিলিয়ন’ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নিরুদ্দেশ। প্রশ্নটা হলো- কোন মেয়াদে? উত্তরটা তার বক্তব্যে ছিল না। বিপত্তিটা হয়েছে সেখানেই। প্রিয়া কি ১৯০১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ১১৯ বছরের হিসাব দিয়েছেন, নাকি ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে, নাকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীন থেকে? পরিসংখ্যানটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেউ আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান রাখলে আর প্রিয়ার ভুল হয়ে থাকলে তার কাছ থেকে সংশোধনী ও দুঃখ প্রকাশ প্রত্যাশিত। তাই বলে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ? যার সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন! ষড়যন্ত্রপ্রিয় দেশের নাগরিক হয়েও আমি শুনিনি, কেউ বাইরের লোকজন ও ক্যামেরার সামনে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। কোনো ব্যক্তির বক্তব্য অপছন্দ হওয়ায় দেশের মানুষকে তার বিরুদ্ধে অন্ধের মতো হিংসাত্মক, কদর্য, বিদ্বেষমূলক মানসিকতায় ঠেলে দেওয়ার বিপদ আমরা অনেক ভোগ করেছি। সেই চর্চা বন্ধ না করলে তার কুফল ভোগ থেকে কেউই বাদ যাবে বলে মনে হয় না। প্রিয়া সাহার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প জানতে চেয়েছেন, তার জমি কে দখল করেছে? প্রিয়ার জবাব ছিল- ‘মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পায়।’
ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে গোপন কিছু ফাঁস করে দিয়েছেন প্রিয়া (!), যা অনেক কষ্টে লুকানো ছিল। এ ক্ষেত্রে বিগত এক দশকে দেশীয় গণমাধ্যমের কিছু খবর স্মরণ করা যাক। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে (বর্তমান ক্ষমতাসীন দলই তখন রাষ্ট্রক্ষমতায়) প্রথম আলো পত্রিকার একটি শিরোনাম ‘দেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমছে।’ খবরটির শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘গত ১১টি আদমশুমারির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ।’ সংক্ষেপে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও উচ্ছেদের ঘটনা বিশ্নেষণ করে বলেছে- ‘রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিচার না হওয়ায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।’ বিশ্নেষণ উপস্থাপনের অনুষ্ঠানে বর্তমান সরকারের নিয়োগ দেওয়া দেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন।
সুপরিচিত অধ্যাপক-গবেষক আবুল বারকাত ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত তার এক গবেষণায় বলেছেন, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ দশকে ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশ ভূখণ্ড ত্যাগে বাধ্য হয়েছে; যা প্রতি বছর গড়ে ১২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন আর প্রতিদিন ৬৩২ জন। অধ্যাপক বারকাতের আশঙ্কা, ‘এই নিরুদ্দেশ প্রক্রিয়ার প্রবণতা বজায় থাকলে আগামী দু-তিন দশক (৩০ বছর) পরে এ দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না (সূত্র :বাংলা ট্রিবিউন)।’ এসব খবরের তুলনায় প্রিয়া সাহার বক্তব্য তুচ্ছতুল্য নয় কি?
তাহলে এত ক্ষোভ-আক্রোশ কেন? একজন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, তাও আবার ট্রাম্পের কাছে নালিশ দিয়ে সহযোগিতা চাওয়ার জন্য? আমেরিকাসহ প্রভাবশালী বিদেশি রাষ্ট্র ও সংগঠন বা ব্যক্তির কাছে দেশের, সরকারের, রাজনীতির সমস্যা-সংকট সম্পর্কে অভিযোগ করে সমাধানের জন্য সহযোগিতা চাওয়া দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পুরনো চর্চা। সরকারেই থাকুক কিংবা বিরোধী শিবিরে, সবাই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার আর নালিশ করে বিদেশি বন্ধুদের কাছে। মানবাধিকার সংগঠন, এনজিও এবং নানা সংগঠন দেশের ভেতরের সমস্যা-সংকট নিয়ে কি বিদেশে নালিশ করে না? সহযোগিতা চায় না? দেশের বহু রাজনৈতিক সংকটে প্রভাবশালী বিদেশি রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে মধ্যস্থতা করতে দেখেছি আমরা। তখন দেশ খাটো হচ্ছে কি-না; রাষ্ট্রের ইমেজ, মানসম্মান নষ্টের কথা কারও মনে থাকে না। দলকানা অনুসারীরা বরাবরই সবকিছুর অন্ধ সমর্থক। নিজের বিবেক, যুক্তি দিয়ে কিছু বিবেচনা করে না। দেশের বহু নাগরিক বিদেশিদের কাছে এমন নালিশের সংস্কৃতি পছন্দ করে না। তারা অসংগঠিত, শক্তিহীন বলে কিছু করতে পারে না। প্রিয়া সাহার অভিযোগ দেশের জন্য বিব্রতকর, লজ্জার; কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর পেছনে ষড়যন্ত্র, দুরভিসন্ধি, নীল নকশা খুঁজে পান বা না পান; রাষ্ট্র, সমাজ যারা চালান তাদের ব্যর্থতায় দেশের মানুষকে যেন আর এমন লজ্জায় পড়তে না হয়, তার জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংকটের যথার্থ সমাধান জরুরি।
জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও তাদের সমমনা উগ্র ইসলামী সংগঠন ও ব্যক্তিরা বাংলাদেশ মুসলমানের দেশ বলে জিহাদি উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে অন্যদেরও উত্তেজিত করছে। বর্তমান ৯০ শতাংশ থেকে বাংলাদেশকে শতভাগ মুসলমানের দেশ করাই তাদের স্বপ্ন। অর্থাৎ অন্য ধর্মের মানুষের জায়গা নেই বাংলাদেশে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান এসব বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’ বলে জেগে ঘুমালেই কি সংকটের সমাধান হবে? দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যাটা তাদের অস্তিত্বের সংকট। প্রিয়া সাহা না বললেও এটা দুনিয়ার কারোরই অজানা নয়। আমরা অন্ধ হয়ে থাকলেই তো আর প্রলয় বন্ধ থাকবে না।
বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়