বৃহস্পতিবার ১২ বৈশাখ, ১৪৩১ ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

মোবাইল স্ক্রিন আসক্তির শিকার শিশুরা

বিষেরবাঁশী ডেস্ক: শহরের শিশুদের খেলার জায়গা নেই- এতো সবার জানা। তবে এর সঙ্গে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শিশুরা মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। লেখাপড়ার বাইরে বেশিরভাগ সময় তারা কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের স্ক্রিনের সামনে কাটাচ্ছে। তাদের এই স্ক্রিন আসক্তির ফলে তারা যেমন ঘরকুনো হয়ে পড়ছে, তেমনি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললে প্রত্যেকের একই কথা, একই অভিযোগ। ‘আমার বাচ্চাটা কোথাও বের হতে চায় না। স্কুল আর বাসা। কারো সঙ্গে খেলে না। মোবাইলে গেমে মাথা গুঁজে রাখে আর না হলে টিভিতে কার্টুন দেখে। কী যে করি!’ ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত মা-বাবার তার সন্তানকে নিয়ে এই আক্ষেপ এখন মুখে মুখে। এই ঘরকুনো মুখ লুকানো বদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া শিশুদের এই দশার জন্য দায়ী কে? নিঃসন্দেহেই বলা যায় মা-বাবা এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাদের অতি সচেতনতা এবং ব্যস্ততাই আমাদের চোখের সামনেই আমাদের সন্তানেরা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলা না করে ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে এই প্রাণের সন্তানগুলো।

মার্কিন জার্নাল ‘পেডিয়াট্রিক্স’-এ প্রকাশিত একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব শিশু প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি দেখে বা কম্পিউটারে খেলার জন্য স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে, তারা অন্য শিশু যারা এসব করে না তাদের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বেশি সমস্যায় ভোগে। তারা বেশি আবেগপ্রবণ হয়, সব কিছুই অতিরিক্ত করে ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়েই যন্ত্রপাতির প্রতি মানুষের একটা বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। যাকে ‘গ্যাজেট প্রেম’ বললে হয়তো ভুল হবে না। স্মার্টফোন, আইফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরার প্রতি বড়দের দেখে শিশুদেরও আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। কারো কারো কাছে এসব ব্যবহার করতে পারাও স্মার্টনেসের পরিচয়। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে এসব মানসিকতা গ্রহণ করছে। ছেলেমেয়েরা মাঠে গিয়ে খেলাধুলার পরিবর্তে কম্পিউটার-মোবাইল ফোনের ছোট স্ক্রিনেই সময় কাটাচ্ছে বেশি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে করে কিশোর-কিশোরীরা সাময়িক স্বস্তি খুঁজে পেলেও এটা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে।

ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পরিচালিত জরিপটির ফলাফল সম্প্রতি ‘পেডিয়াট্রিক্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। সেখানে ১০ থেকে ১১ বছর বয়সী ১০১৩ জন শিশুর ওপর জরিপটি করা হয়। এদের কেউ কেউ দৈনিক পাঁচ ঘন্টা পর্যন্ত টিভি দেখে অথবা কম্পিউটারে গেম খেলে। আবার কেউ কেউ এক মুহূর্তও টিভি দেখে না বা কম্পিউটারে খেলে না। শিশুদেরকে ২৫টি করে প্রশ্ন করা হয়। দেখা গেছে, যেসব শিশু দুই ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় টিভি দেখে বা কম্পিউটারে খেলাধুলা করে তাদের চেয়ে যেসব শিশু এতো সময় স্ক্রিনের সামনে বসে থাকে না তারা বেশি নম্বর পেয়েছে। জরিপে আরো দেখা গেছে, যেসব শিশু শারীরিকভাবে সবল অথচ স্ক্রিনের সামনে দিনে ২ ঘণ্টা বা ততোধিক সময় অতিবাহিত করে তারাও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অর্থাত্ স্ক্রিনের সামনে বেশি সময় অতিবাহিত করাই প্রধান সমস্যা।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, অনেক অভিভাবক ও শিশু মনে করে কম্পিউটার বা টিভির সামনে বেশি সময় অতিবাহিত করা যুক্তিসঙ্গত হবে যদি তা ‘ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাত্রার’ একটি অংশ হয়। শিশুরা যদি শারীরিকভাবে সবল হয় তবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার উদ্বেগের কোনো বিষয় নয়। তবে তারা অভিভাবকদের এই উপদেশ দিয়েছেন যে শিশুদের সুস্বাস্থ্যের জন্য টিভি-কম্পিউটারের সামনে তাদের কম সময় অতিবাহিত করাই ভাল।

শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে গত বছর একটি বই লিখেছেন মার্কিন সাইকোথেরাপিস্ট ও আসক্তি বিশেষজ্ঞ ড. নিকোলাস কারদারাস। ‘গ্লো কিডস: হাউ স্ক্রিন এডিকশন ইস হাইজেকিং আওয়ার কিডস এন্ড হাউ টু ব্রেক দ্য ট্রেন্স’ নামের এই বইয়ে তিনি স্ক্রিন এডিকশনকে ‘নতুন শতাব্দির মাদক’ বলে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয় এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, স্ক্রিন আসক্তির চিকিত্সা হেরোইন আসক্তির চেয়েও কঠিন।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ একে অপরের পরিপূরক হলেও এতদিন শিশুর শারীরিক বিকাশকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। অথচ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়া। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিশেষ করে শহর এলাকার শিশুদের জীবনে বিনোদন নেই। সে জন্য তারা আকাশ-সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে। স্ক্রিন আসক্ত হয়ে পড়ছে। স্কুলে খেলার মাঠ নেই, পাড়ায় খেলার মাঠ নেই। কিন্তু এটাও সত্যি যে নগর জীবনে এ বাস্তবতা আমাদের মেনে নিয়েই এগোতে হবে। রাজউকের নিয়ম করা উচিত, নতুন বাড়ি তৈরির সময় কমন স্পেস রাখা যেখানে শিশুরা খেলবে। প্রতিটি এলাকার খোলা জায়গায় সরকারি উদ্যোগে শিশু পার্ক গড়ে তোলা দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে মা-বাবার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

শিক্ষাবিজ্ঞানের সর্বজনীন নির্দেশনা হলো, শিশুকে শিক্ষিত করে তুলতে হলে তাকে তার শরীর, মন ও মস্তিষ্ক সব কিছুরই চর্চা করার যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে। অথচ আমাদের দেশের রাজধানীর শিশুরা নানা নাগরিক সুবিধা পেলেও খেলার সুযোগ পাচ্ছে না। বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে, মুক্ত আলো-বাতাসে খেলার বা শরীর চালনা করার কোনো সুযোগ বা ব্যবস্থা নেই; বাড়ির সামনে তো নয়ই। বরং এমনও দেখা গেছে স্কুলের মাঠে আয় বৃদ্ধির নামে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে শিশু-কিশোররা কম্পিউটার ও মোবাইলে গেমে অভ্যস্ত হচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে শরীর নির্ভর খেলা। তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে না, এতে প্রায় শিশুরা খিটখিটে মেজাজের হয়ে উঠছে, অপরিপক্ক আচরণ করছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, পৃথিবীর সব শহরেই এই সমস্যা রয়েছে। শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ বাধা দূর করতে পারে সরকার। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এ সংকট কমে আসবে। আর পরিবারের সদস্যদের সচেতন হতে হবে সবচেয়ে আগে। তাদের বুঝতে হবে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে তার দায়িত্ব রয়েছে, সব দায়িত্ব শুধু সরকার বা স্কুলের শিক্ষকের নয়।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহিত কামাল বললেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা অসামাজিক হয়ে পড়ছে মূলত মা-বাবার কারণে। মা-বাবাকেই সবচেয়ে বেশি সময় দিতে হবে। খেলার সুযোগ না থাকলে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে আত্মীয়-বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। এটা করলেও বাচ্চারা সামাজিকতা শিখবে। সেখানে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে যেমন তাদের সহ্য ক্ষমতা বাড়বে, তেমনি মা-বাবাদের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার দেখেও তারা শিখবে।

মনোবিজ্ঞানীরা আরো বলছেন, শিশুকে প্রতি মুহূর্তে দিতে হবে মধুর অভিজ্ঞতা, সুন্দর সাজানো সময়। শিশুকে প্রচুর খেলাধুলার সুযোগ দিতে হবে। খেলার মাধ্যমে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাড়ে। শিশুদের আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে বড়দের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। বড়রা যদি শিশুদের প্রতি দয়া, সুবিবেচনা ও ভালবাসা দেখায় তবে শিশুরাও এসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। এতে তার মানসিকতা ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত হবে।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

Leave A Reply

Your email address will not be published.