রশিদ আল রুহানী: হেফাজতের ২৯টি দাবির সবকটি পূরণ করে চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনে সরকার। এ নিয়ে সমালোচনা হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দু’টি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। দুই কমিটির মধ্যে একটি পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট পর্যালোচনা ও পরিমার্জন , অন্যটি বই সহজীকরণ ও সুখপাঠ্য করতে কাজ করছে। কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মাথায় রেখে কনটেন্ট পরিবর্তনের প্রস্তাব করবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে যেসব গল্প ও কবিতা পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তার সবই ফিরিয়ে আনাসহ পরিমার্জনের প্রস্তাব দেবে বিশেষজ্ঞ কমিটি। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মাথায় রেখে, নৈতিক শিক্ষা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে হবে। ইতোমধ্যে পরিমার্জন ও পর্যালোচনা কমিটি এ বিষয়ে তিন থেকে চারটি মিটিং করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পাঠ্যবই পরিবর্তন-পরিমার্জনের বিষয়টি এত সহজ নয়। এটি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। কিছু পরিবর্তন হলেও সেটি এমনভাবেই করার চিন্তা রয়েছে, যেন পরে কোনও সমস্যা না হয়। একটি বই বার বার পরিবর্তন করা ঠিক নয় এবং সম্ভবও নয়।’
আগামী বছর বইয়ে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আসছে না জানিয়ে অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এবছর শুধু পাঠ্যবই সহজীকরণ, সাবলীল ও সুখপাঠ্য করার কাজ চলছে।’ তবে যদি পরিবর্তন আসে সেটা আগামী বছর নয়, হয়ত পরের বছর কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাঠ্যবইয়ে থাকা বিকৃতি ও ভুল পরিবর্তন করে সংশোধন আনা হচ্ছে
এদিকে চলতি বছরে প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ এর পাঠ-১২ (অধ্যায়) তে ‘ও-তে ওড়না চাই’ এর পরিমার্জন করে ‘ও-তে ওজন’ দিয়ে ভিন্ন ছবি বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবার একই বইয়ের বর্ণ পরিচয়ে (পাঠ-৭) ‘অ’ শেখাতে গিয়ে ‘অজ’ হিসেবে ছাগল গাছে উঠে আম খাচ্ছে, এমন ছবি পরিবর্তন করে ছাগলকে টেনে গাছের নিচে নামানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘‘সমালোচনার পরে উল্লিখিত দু’টি বিষয়ে (ও এবং অ) শিক্ষামন্ত্রী নিজে সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ীই বর্তমানে এটি পরিবর্তন করা হচ্ছে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণিতে কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্’ রণ সংগীতেও বাদ পড়া অংশটুকু যুক্ত করা হচ্ছে।’’
ইতোমধ্যেই কমিটি কিছু বিকৃতি ও ভুল সংশোধন করেছে বলে এনসিটিবি’র দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বই ‘আমার বাংলা বই’ কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় যে লাইনগুলো বিকৃত করা হয়েছিল, তাও এবার ঠিক করা হচ্ছে।
পঞ্চম শ্রেণিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতায় অন্তত চারটি স্থানে বিকৃত করা হয়, যা পুনরায় ঠিক করা হচ্ছে।
অন্যদিকে গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’ কবিতা থেকে ‘অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি/বিচার দিনের স্বামী’ এই অংশ বাদ দেওয়া হয়, যা এবার যুক্ত হতে পারে বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ে প্রচুর বানান ভুল রয়েছে। শুধু বানানই নয়, অনেক কবিতার তথ্য বিকৃতিসহ নানা রকম অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। আবার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে অনেক তথ্য কঠিনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব অসঙ্গতি সবই ঠিক করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি’র সদস্য ড. মিয়া ইনামুল হক।
এদিকে নবম ও দশম শ্রেণির ১২ ধরনের বই সহজ ও সুখপাঠ্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে মিয়া ইনামুল হক বলেন, ‘বইয়ের যত ভুলভ্রান্তি রয়েছে; যেমন, বানান, জটিল বিষয় সহজীকরণের কাজ প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে। সেগুলো আবারও দেখছি কোথায় কোনও ভুল থাকছে কিনা।’
এদিকে চলতি বছর হেফাজতের ২৯টি দাবি পূরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে বেশ কিছু পদ্য, গদ্য ও প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ শিক্ষাবিদদের। তারা বলছেন, সেই সঙ্গে যুক্ত করা হয় হেফাজতের প্রস্তাব করা লেখাগুলো। কিন্তু এসব লেখা শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীদের জন্য কতখানি উপযুক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, তাও বিশ্লেষণ করছে বিশেষজ্ঞ কমিটি।
পাঠ্যবইয়ে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছিল
দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘সবাই মিলে করি কাজ’, তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)’ যুক্ত করা হয়। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘বিদায় হজ’ ও ‘শহিদ তিতুমীর’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাদ যায়, হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতাটি। কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ কবিতার চারটি স্থানে বিকৃত করা হয়। এ ছাড়া গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’ কবিতা থেকেও একটি লাইন বাদ দেওয়া হয়।
ষষ্ঠ শ্রেণির ‘চারু পাঠ’ থেকে এস. ওয়াজেদ আলীর ‘রাঁচি ভ্রমণ’ ও সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’ বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘সততার পুরস্কার’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘নীল নদ আর পিরামিডের দেশ।’ এছাড়া সানাউল হকের কবিতা ‘সভা’ বাদ পড়েছে, যুক্ত হয়েছে জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী।’
সপ্তম শ্রেণিতে বাদ পড়েছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লাল ঘোড়া’, সুকুমার রায়ের ছন্দবদ্ধ ‘আনন্দ’ কবিতা, স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘উপদেশ’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাটি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লেখা রণেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’ গল্পটিও বাদ পড়ে। অষ্টম শ্রেণিতে কালিদাস রায়ের ‘বাবুরের মহত্ত’ এর বদলে কায়কোবাদের ‘প্রার্থনা’ ও জসীমউদ্দীনের ‘দেশ’ কবিতার বদলে ‘রূপাই’ যুক্ত হয়। অষ্টম শ্রেণির সহপাঠ থেকে উপ্রেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘রামায়ণ কাহিনী-আদিখণ্ড ’ শীর্ষক গল্পটি বাদ পড়ে।
নবম শ্রেণির বাংলা বই থেকে বাদ পড়ে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনী ‘পালামৌ’, মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরী’। কবিতা বাদ পড়েছে,জ্ঞানদাস রচিত ‘সুখের লাগিয়া’ ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর রচিত ‘আমার সন্তান’, বাংলার মানবতাবাদী সংস্কৃতির প্রতীক মরমী সাধক লালন শাহ রচিত ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কবিতা। বাদ পড়ে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে।’
কমিটির সদস্যরা যা বলেন
বাংলা বিষয়ের পরিমার্জন ও সহজীকরণের দায়িত্বে আছেন শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে কী কী পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও ভাবছি। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি বেশ জটিল ও সেন্সেটিভ।’
এদিকে গণিত ও বিজ্ঞান বইগুলো সহজপাঠ্য করার দায়িত্বে থাকা বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কায়কোবাদ বলেন, ‘আমরা কাজটি যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছি। বইয়ে তো প্রচুর ভুল ছিল, সেগুলো চেষ্টা করেছি ঠিকঠাক করতে। এর বাইরে গণিত ও বিজ্ঞান বইয়ে কোনও বড় ধরনের পরিবর্তন নেই। ’
ইংরেজি বই সহজ পাঠ্যকরণ কমিটির দায়িত্ব রয়েছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ইংরেজি বইয়ে কোনও কনটেন্ট পরিবর্তন হচ্ছে না। শুধু সহজবোধ্য করা হচ্ছে। কোথাও কোনও ভুল বাক্য থাকলে তা ঠিক করা হচ্ছে। যতটুকু পেরেছি, করেছি। শতভাগ ঠিকঠাক করা একটু কঠিন।’ যদি সুযোগ থাকে আগামী বছর ইংরেজি বইয়ের কিছু কনটেন্ট পরিবর্তনের প্রস্তাব দেবেন বলেও জানান এই শিক্ষাবিদ।
এ বিষয়ে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘কোনও কনটেন্ট পরিবর্তন করতে হলে মন্ত্রণালয় যে কমিটি করে দিয়েছে, ওই কমিটি ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির (এনসিসিসি) কাছে প্রস্তাব করবে। সেই প্রস্তাব কতটুকু রাখবে কি রাখবে না, তা দেখবে এনসিসিসি। তারপর এনসিসিসি আমাদের কোনও নির্দেশনা দিলে সেভাবেই কাজ করা হবে। এখনও আমরা এমন কোনও নির্দেশনা পাইনি। সুখপাঠ্য করার নির্দেশনা পেয়েছি , সেভাবেই গঠিত কমিটি কাজ করছে। ’
উল্লেখ্য, এ বছর (২০১৭) পাঠ্যবইয়ে ব্যাপক পরিবর্তন, বানান ও তথ্য বিকৃতির সমালোচনার পর শিক্ষামন্ত্রণালয় গত ৮ জানুয়ারি দু’টি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি বর্তমান পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট পরিবর্তন ও পাঠযোগ্য করতে কাজ করছে।
পাঠ্যবই আরও পাঠযোগ্য করার সুপারিশ দিতে গঠিত কমিটিতে আছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনজুর আহমদ, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ, মতিঝিল সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক তানজীল আশ্রাফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম ও এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা।
নবম-দশম শ্রেণির নির্বাচিত কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করে সুখপাঠ্য, আকর্ষণীয় ও সহজ করার লক্ষ্যে গঠিত অন্য কমিটির সদস্যরা হলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, অধ্যাপক এম এম আকাশ, বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম, উদয়ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান সদস্য সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন।
বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়