শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

ঢাকার ছিন্নমূল মানুষদের দেখার কেউ নেই

জুবায়ের চৌধুরী : রাজধানীর মতিঝিলে এজিবি কলোনি বাজারের পাশে রাস্তার ওপরেই দুই সন্তানসহ ছোট্ট সংসার ছিন্নমূল সাথী আক্তারের। চার মাস আগে স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে। এরপর থেকে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফুটপাতেই তার বসবাস। নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই, জীবন চলছে অন্যের দয়ায়। সাথী জানালেন, ‘কেউ দিলে খাই, না দিলে না খেয়েই পড়ে থাকি।’

পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডের ফুটপাতে থাকা লিপি আক্তারের অবস্থা আরো খারাপ। এক মাস আগে তার ভাই তাকে ফেলে রেখে যায়। শারীরিক প্রতিবন্ধী এই মানুষটির পাশে দাঁড়িয়েছেন এই সমাজেরই কয়েকজন মানুষ। তারাই প্রতিদিন লিপিকে দেখভাল করছেন। তবে লিপির আশ্রয় হচ্ছে সেই ফুটপাতই। এই ছিন্নমূল মানুষদের নেই স্থায়ী ঠিকানা। তাই তারা কখনো পান না জাতীয় পরিচয়পত্রও। ফলে কখনো সরকারের দৃষ্টি পড়ে না তাদের ওপর। তারা বরাবরই থাকছেন নাগরিক সুবিধার বাইরে।

এক বছর আগে বগুড়ার হতদরিদ্র রশিদ মিয়ার ছোট ঘরটি বন্যায় নদীর পেটে চলে যায়। নদীভাঙা রশিদ তিন শিশু আর স্ত্রীকে নিয়ে এখন ঢাকায়। ঠাঁই মিলেছে আরামবাগ-নয়াপল্টনমুখী রাস্তার পূর্বপাশের ফুটপাতে। মাটি কাটা, ইটভাঙার মতো কায়িক শ্রমে কোনোমতে চলছে সংসার। এ রকম আরো বেশ কয়েকজন আছেন ওই ফুটপাতে। দেড় কোটির ওপরের জনসংখ্যার এই ঢাকা মহানগরের ফুটপাতে বসবাস করা ৫০ হাজার ছিন্নমূল মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন বস্তিতে থাকছেন প্রায় ৪০ লাখ। সারা দেশে তাদের সংখ্যা আরো বেশি।

শুধু সাথী আক্তার, রশিদ মিয়া কিংবা লিপিই নয়, রাজধানীজুড়ে এরকম ছিন্নমূল মানুষ হাজারে হাজার। ফুটপাতই তাদের সংসার, ঘরবাড়ি। খেয়ে না খেয়ে পড়ে থাকেন সেখানেই। ঢাকার ছিন্নমূল এই মানুষদের দেখার কেউ নেই। অথচ রাষ্ট্রের কাছে এদের জন্য বরাদ্দ আছে শত কোটি টাকা। কিন্তু সেই টাকা কখনোই পৌঁছায় না তাদের কাছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিজেদের তাগিদে ছিন্নমূল মানুষের জন্য কোনো কাজও করছে না।

তবে সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বললেন, কেউ আবেদন করলে তাদের পুনর্বাসন করা হবে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে মানুষটির অক্ষরজ্ঞান নেই, নেই নিজ অধিকারের ধারণা। তার পক্ষে আবেদন করা কঠিন। তাই সরকারকে নিজ উদ্যোগেই হাত বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

জানা গেছে, রাজধানীতে প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ছিন্নমূল মানুষ বাড়ছে। সরকারি সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা ১ হাজার ৬০০। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর হিসাবে তা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ফুটপাতে দিনযাপন করা এসব ছিন্নমূল মানুষ ন্যূনতম নাগরিক অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত, তেমনই নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তাও। তাই তাদের রাষ্ট্রীয় মূলধারায় নিয়ে আসার দাবি সমাজকর্মীদের। তারা মনে করেন, এতে করে সমাজে ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও সুফল আসবে।

কোয়ালিশন ফর আরবান পুওরের (কিউএফএপি) নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবেকা সেরনিয়াবাত বলেন, অন্য দেশ থেকে পালিয়ে এসে এই দেশে ঘর-বাড়ি, খাবার-দাবার পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু এই দেশের বাসিন্দা হয়েও ছিন্নমূল মানুষরা কিছুই পাচ্ছে না। তারা কি এ দেশের মানুষ না? তারা কেন রাস্তায় পড়ে কষ্ট করছে? যত দ্রুত সম্ভব ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসনের দাবি এই সমাজকর্মীর।

ছিন্নমূল মানুষ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বলছে, এসব ছিন্নমূল মানুষ ৩০-৩৫ বছর ধরে থাকছেন ফুটপাতে। অনেকের ফুটপাতেই বিয়ে হয়েছে, সন্তানাদিও হয়েছে। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তাদের আবাসন সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাদের সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা বা গোসলের কোনো ব্যবস্থা নেই। দুবেলা পেটভরে খেতেও পারে না তারা। কার্যত নিঃস্ব তারা। খোলা আকাশ আর ঝুপড়ি ঘরেই থাকতে হচ্ছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। মাঝে মধ্যেই চলে উচ্ছেদ অভিযান। ভেঙে দেওয়া হয় খুপরি ঘরগুলো। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে নাগরিক জীবনে। বড় বড় অট্টালিকা আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সয়লাব গোটা নগর। কিন্তু বাস্তুচ্যুত এই ছিন্নমূল মানুষের কপালে সামান্য আশ্রয়টুকুও মেলে না।

বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে যুক্ত মানুষের অধিকাংশই হতদরিদ্র। এরা রিকশা ও ভ্যান চালিয়ে বা দিনমজুরি করে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় আসে। বাসাবাড়ি বা উন্নত স্থাপনায় থাকার সাধ্য না থাকায় অধিকাংশই ওঠে বস্তিতে। পরে বস্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ফুটপাতের বাসিন্দা হয় তারা। যে কারণেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে চোখ যেতেই দেখা যায় পলিথিনের ঝুপড়ি। কমলাপুর রেলস্টেশন, রেললাইন, মহাখালী, সায়েদাবাদ ও কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা, গুলিস্তান, মতিঝিল, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, বেড়িবাঁধসহ নগরীর প্রায় সর্বত্রই এ রকম ঝুপড়ি চোখে পড়ে। এগুলো মূলত আশ্রয়হীন মানুষের ডেরা। দেশের নাগরিক হয়েও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

নিউজ২৪ ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: জাতীয়

Leave A Reply

Your email address will not be published.