শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

বাবাকে নিয়ে এ সময়ের সবথেকে অাবেগঘন লেখা `বাবা, অামার বাবা’ লেখাঃ কবি ফয়সাল হাবিব সানি

বিশেরবাঁশী ডেস্ক: অামি জানি, তুমি ভালো নেই বাবা। অামার সাথে তোমার কথা হয়নি ঢের ৫ বছর। অামি বাড়িতে এলেও তোমার সাথে অার কথা বলিনা। তুমিও বলোনা। হয়ত অামি বলতে চাই, পারিনা; কিংবা তুমি বলতে চাও, পারোনা। শুনেছিলাম, অামি প্রথম যেদিন পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় সেদিন তুমি ভীষণ কান্না করেছিলে, বাবা! ইসস, পুরুষেরাও যে কাঁদতে পারে তা প্রথম তোমার কাছ থেকেই জানলাম। অাচ্ছা বাবা, প্রথম বাবা হবার মুহূর্তে কি পুরুষদের কাঁদতে হয়, নাকি অশ্রুর নামে পুঞ্জিত কোনো মহা অানন্দের শিশিরকণা কিংবা হীরার খনি জ্বলজ্বল করে তাঁদের চোখে! জানো বাবা, মা অামায় বলেছিল, অামি যখন ছোটকালে মায়ের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে থাকতাম, তখন নাকি তুমি মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুহূর্তেই অামায় নিয়ে কোথায় হারিয়ে যেতে। মা ঘুম থেকে উঠে অামায় না পেয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করত, ছোটাছুটি করত। কী যে ভীষণ ভয় ও শঙ্কায় ঘাবড়ে যেত মা! কিন্তু মা জানত এই পাগালিমটা তুমিই করেছো। মা অামায় প্রায়ই বলত, তুমি নাকি প্রায়ই এমনটি করতে।

বাবা, তোমার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে? সেই রাতে অামার কী ভীষণ বায়না হল, দই খাবো। অামায় তুমি কোনো এক দাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলে যেন। দাওয়াতে ভাত-মাংসর সাথে দই দিয়েছিলো খেতে। দই যতটুকু দিয়েছিল ততটুকু খাওয়ার পর অামার অাবার দই খেতে খুব ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু যাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছিলাম, তাদের দাওয়াতের সবটুকু দই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অামার অবুঝ মনের বায়না অার কান্না তখন থামায় কে! খাবো বলেছি তো খাবোই। তখন রাত প্রায় ২টা বাজে। এত রাতে অামাদের এলাকায় কোনো দোকান খোলা নেই। কিন্তু অামার চোখের জল তুমি সহ্য করতে না পেরে সেই রাতেই ৫ কি.মি দূরে শহরের এক দোকান থেকে অামার জন্য দই কিনে এনেছিলে। তারপর অামার চোখের জলে তোমার কোমল হাতের অাঙ্গুল ছুঁয়ে কী সহজেই অামার কান্না মোচন করেছিলে, বাবা! অামার কেবল মনে হয়, `বাবা, তোমার মতো কেউ অামাকে কখনো বুঝতে পেরেছিলো কি?’

তোমার নাকি বিদেশের সংবাদ মাধ্যম থেকে ফট্রোগ্রাফি নাকি কিসের জন্য বারবার অফারও অাসত। কিন্তু তুমি অামার জন্যই নাকি সেখানে যাওনি। তুমি বলেছিলে, তোমার ছেলেকে রেখে কোথাও যাবে না তুমি। সত্যিই কি অামাকে রেখে কোথাও যাওনি বাবা? যাই হোক, অামার জন্য এতটা ত্যাগ তুমি কেন করলে, বাবা! কুড়িটা বছর পর অামি অার তুমি কতই না দূরে থাকি। পড়াশুনার তাগিদে অামায় এখন বাইরে থাকতে হয়। কিন্তু অামি জানি, এইটা কোনো দূরে থাকা নয়; দূরত্ব কেবলমাত্র অামাদের সরিয়ে রেখেছে, বাবা। অামার প্রতিক্ষণ প্রতিমুহূর্ত মনে হয়েছে অামি যেন তোমার সেই ছোট্ট ছেলেটির মতই তোমার গালে চুমো খেয়ে অাদরে-অাহ্লাদে তোমার গাল ভরিয়ে তুলছি, তোমার কোলে মাথা রেখে ঘোড়ার পিঠে চড়ব বলে বায়না ধরছি, এইটা-সেইটা কিনে দিতে হবে বলে হাত-পা ছুঁড়ে তোমাকে মারছি, কী ভীষণ মারছি (হা হা হা)!

তোমার মনে অাছে বাবা, তোমায় না দেখে অামি কখনো ঘুমাতে যেতাম না। তুমি বাইরে থেকে অাসতে, তারপর তোমার গাল চুমোয় অার চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে অামি চোখ বন্ধ করে কী এক অব্যক্ত শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তাম। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে সে কী এক বৈষম্যই না অামার! মায়ের গালে যেখানে চারটা চুমো খেতাম, তোমার গালে সেখানে দ্বিগুণ হয়ে অাটটা এসে পড়ত। অারও তোমার মনে অাছে বাবা, তুমি ঘোড়া হতে, অার অামি তোমার ঘাড়ে চেপে তোমার পিঠে চড়তাম। অার তুমি ঘোড়ার মত হাটু মুড়ে অামাকে পিঠে করে চড়ে নিয়ে বেড়াতে। অাহা! কী মধুর ছিলো সেই দিনগুলো, সেই প্রত্যেকটি মুহূর্ত! অামি কি কখনো অার তোমার সেই ছোট ছেলেটি হতে পারব, বাবা? বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে নাকি ছেলের সাথে বাবার সম্পর্কও দূরে সরে যায়! তাহলে অামাদেরও কি তাই হয়েছে, বাবা? বলো না বাবা, তাই হয়েছে কি?

সূর্য অস্ত যাবার সময় এসেছে দিগন্তে। কোলাহলপূর্ণ চারদিক নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া। হাস্যোজ্জ্বল গোধূলি এখন তমসাচ্ছন্ন অন্ধকারকে ভালোবেসে তার গায়ে ঢেলে দিয়েছে অাবিরের ফোয়ারা। ওইদিকে রংধনুর সাতটি রঙ ছেয়ে দিয়েছে ধূসর অাকাশের বুক। অামার বুকে খানিকটা তখন শূন্যতা। অামার বাবা ঘুমিয়ে থাকে অামার বুকে। বাবার সাথে অামার দূরত্বের শূন্যতা মাপতে মাপতে অামিও ভুলে যাই রঙিন অাবিরমাখা প্রশান্ত বিকেলের গল্প। এখন প্রায়ই অামার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা, অারেকটিবার অামায় কোলে তুলে নাও; অামি এবার অাটটি নয়, ষোলটি চুম্বনের ভারে ভরিয়ে দেবো তোমার গালের সবটুকু অাদল। বাবা, কখনো বলতে পারিনি খুব ভালোবাসি তোমাকে। বাবা, লাভ ইউ অ্যা লট।

কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর তার প্রধান অাশ্রয়স্থল হয় মা-বাবা। মায়ের দুগ্ধ পান ছাড়া যেমন শিশু বয়স অকল্পনীয়, তেমনি বাবার স্নেহ-মমতা ছাড়াও শিশু বয়স বড্ড অপূর্ণ ও দুর্ভাগ্যের! একজন মা যেমন তার বুকের দুধ পান করিয়ে, তার স্নেহের অারশতলে রেখে শিশুকে বড় করে তোলে, তেমনিরূপে বাবার ভূমিকাও অগ্রগণ্য। একজন মা কখনোই সন্তান জন্ম দিতে পারে না বাবার অনুপস্থিতিতে। মা-বাবার যুগল মিলনেই সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখে। একজন মায়ের অবদান যেমন তার সন্তানের জন্য ঈর্ষণীয়, অনুরূপভাবে একজন বাবাও ঘর্মপিষ্ট দেহে, অক্লান্ত অসহ্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তার কলিজার ধন সন্তানের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেবার সংস্থানে পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে।

বাবা তার বিনিময়ে কিছুই চায় না। এত কষ্টের পরও যখন বাড়িতে এসে তার সোনামণির হাসি মুখখানা দেখে সমস্ত কষ্টই যেন নিমেষেই ম্লান হয়ে যায় তাঁর। সন্তানের জন্য কী না করে একজন বাবা! অার বার্ধক্যে সেই সকল বাবার স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমের দুঃসহ সুখালয়ে! সন্তানের জন্য নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দেয় একজন বাবা, নিজের অানন্দ-সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের অানন্দ-সুখের যোগাড়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে প্রতিটা মুহূর্তে। পৃথিবীর সকল বাবাকে স্যালুট, ভালো থাকুক পৃথিবীর প্রত্যেক বাবা। বাবাদের চরণতলে জন্ম হোক সন্তানের অাগামী ভবিষ্যতের অার যেন বৃদ্ধাশ্রমে যাবার অাগে নিজের মৃত্যু নিজের চোখেই দেখতে হয় বাবাদের। `বাবা, অামার বাবা’ অামার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। কেবল শেষবারও বলা হলো না শুধু `তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা’।

বিশেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/ইলিয়াছ

Categories: খোলা বাতায়ন,সাহিত্য

Leave A Reply

Your email address will not be published.