বৃহস্পতিবার ১৪ চৈত্র, ১৪৩০ ২৮ মার্চ, ২০২৪ বৃহস্পতিবার

মাদক ব্যবসায়ীর পক্ষ নিয়ে নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসালেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা?

বিশেরবাঁশী ডেস্ক: মাদক ব্যবসায়ীর পক্ষ নিয়ে নির্দোষ এক ব্যক্তিকে মামলায় ফাঁসিয়ে জেল খাটানোর অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর ভাষানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও পরিদর্শকের (তদন্ত) বিরুদ্ধে। একলাখ টাকা চাঁদা দাবির পর ভুক্তভোগী টাকা দিতে না পারায় প্রথমে হেরোইন দিয়ে মামলার হুমকি ও পরবর্তীতে অন্য একটি মামলা দিয়ে তাকে জেলে পাঠান ওসি মুন্সি সাব্বির আহমেদ ও পরিদর্শক (তদন্ত) নূরুল ইসলাম। গত ২৪ মে ‘আইজিপি কমপ্লেইন মনিটরিং সেলে’ ঘটনার শিকার কামাল উদ্দিন এই অভিযোগ করেন।

অভিযোগে বলা হয়, গত ৮ মে ভাষানটেক এলাকায় মুসলিম মডার্ন স্কুল সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে সাগরিকার দিকে রিকশায় যাচ্ছিলেন কামাল। পথে জটলা দেখে, কী হয়েছে জানতে গেলে এক নারী তার দিকে তেড়ে আসেন এবং জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই কে? তুই কি সাংবাদিক?’ নিজেকে সাধারণ মানুষ পরিচয় দেওয়ার পরও সাংবাদিক ভেবে তাকে মারধর করে স্থানীয় রাঞ্জু বেগম, তার ছেলে ইমু, তাদের সহযোগী সুজন, ইমরানসহ বেশ কয়েকজন। এক পর্যায়ে পুলিশ কামাল উদ্দিনকে ভাষানটেক থানায় নিয়ে যায়।

থানায় নেওয়ার পর সত্য ঘটনা জেনে পুলিশ ছেড়ে দেবে, কামাল সেই আশা করলেও মূলত তা হয়নি। অভিযোগপত্রে কামাল উদ্দিন উল্লেখ করেন— ভাষানটেক থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নূরুল ইসলাম কোনও কথা না শুনেই বলতে লাগলেন, ‘তাদেরকে তুই চিনিস? তুই হচ্ছিস সাধারণ মানুষ, আর ওরা এই এলাকার স্থানীয় মাদক ডিলার ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী। তোকে মাথায় লম্বা চুলওয়ালা যে ছেলেটা নিয়ে আসলো, তার নাম হলো ইমু। কচুক্ষেত পুরনো বাজারের মাদক ব্যবসায়ী। ইমুর মাকে তুই চিনিস? সে কচুক্ষেত এলাকার নূরুল ইসলাম হত্যা মামলার প্রধান আসামি। তারা প্রতিমাসে আমার থানায় তিন-চার লাখ টাকা দেয়। এখন তুই-ই ভেবে দেখ, তাদের কী ক্ষমতা।’

এভাবে ভয় দেখানোর পর পুলিশের পরিদর্শক নূরুল ইসলাম ঘটনার শিকার কামাল উদ্দিনকে বলেন, ‘তোকে যদি ছেড়ে দেই, অথবা ইমু গংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই, তাহলে আমার ও ওসি স্যারের খবর আছে। তার চেয়ে ভালো তুই আমাকে ও ওসি স্যারকে একলাখ টাকা দে। তোকে সাধারণ মামলা দিয়ে দেবো। তুই ১০-১২ দিন জেল খেটে বের হয়ে আসবি। আর যদি টাকা না দিস, তবে তোকে হেরোইন দিয়ে মামলা দিয়ে দেবো। কমপক্ষে ছয় মাসের আগে বের হতে পারবি না।’ এক লাখ টাকা পুলিশকে দেওয়ার সামর্থ্য না থাকার কথা জানানোর পর কামাল উদ্দিনকে ওসি মুন্সি সাব্বির আহমেদের কক্ষে নিয়ে যান পরিদর্শক নূরুল ইসলাম। টাকা দিতে না পারার বিষয়টি শোনার পর ওসি কামালকে পিটিয়ে সাইজ করার নির্দেশ দেয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘ওরে পিটায়া সাইজ কইরা ফালাইলে ও টাকা দিতে রাজি হবে, ওর বাবাও রাজি হবে।’

এরপর ওসির নির্দেশে থানার উত্তর-পশ্চিম কোণে ব্যারাকের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় কামাল উদ্দিনকে। সেখানে রশি দিয়ে বেঁধে তাকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন কামাল। জ্ঞান ফেরার পর একটি মামলায় আসামি করে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। সেই মামলায় জামিন নিয়ে গত ১২ মে কামাল বের আসেন বলে অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়েছে।

রাঞ্জু বেগম, তার ছেলে এবং অন্য সহযোগীরা রাস্তায় কেন তাকে মারধর করেছিল, জানতে চাইলে কামাল উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দা হেলেনা নামে এক নারীর সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরোধ ছিল। হেলেনা মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলায় তারা দীর্ঘদিন ধরেই তার ওপরে ক্ষিপ্ত ছিল। ঘটনার আগের দিন ভাষানটেক থানায় মাদক ব্যবসায়ী রাঞ্জু বেগম, তার ছেলে ও অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন হেলেনা। এ কারণে ঘটনার দিন তাকে (হেলেনাকে) আটকে রাখে মাদক ব্যবসায়ীরা।’ তিনি বলেন, ‘এখানে কী হচ্ছে, আমি তা জানতে চাওয়ায় তারা ভাবে আমি সাংবাদিক। আর সাংবাদিক ভেবে তারা আমাকে মারধর করে পুলিশে দেয়। পরবর্তীতে পুলিশ আমার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরও মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে হেলেনা ও আমার বিরুদ্ধে মামলা দেয়। আমরা নাকি তাদের ওপরে আক্রমণ করেছি।’

কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনার আগে পর্যন্ত হেলেনা কে, আমি তা জানতাম না, চিনতামও না। অথচ পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে আমাকে মারধর করলো। ফের আমার বিরুদ্ধেই মামলা দিলো।’ মামলায় আসামি হয়ে আদালতে হাজির হওয়ার পর অন্য আসামি হেলেনার সঙ্গে প্রথম কথা হয় বলে জানান কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হেলেনা কে, রাঞ্জু কে? তাদের কাউকে চিনতাম না। জটলা দেখে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হইছে? আর এটাই আমার জন্য কাল হলো।’

শুধু কামাল উদ্দিনকেই নয়, মাদক ব্যবসায়ীরা ঘটনার দিন হেলেনাকেও মারধর করেছিল বলে জানিয়েছেন হেলনা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে সব সময় আমার অবস্থান ছিল। যে কারণে ওরা আমার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। এছাড়া, ঘটনার আগের দিন আমি ভাষানটেক থানায় মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলাম। এজন্য তারা আমার প্রতি আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়। আমাকের আটকে রাখে, মারধর করে। আবার আমার বিরুদ্ধেই পুলিশের সহায়তায় মামলা দিয়েছে।’ ঘটনার দিন কলাপসিবল গেটের ভেতরে আটকা ছিলেন বলে জানান হেলেনা। ‘আর এই গেট খোলার সময় টানাটানিতে মাদক ব্যবসায়ীদের একজন হাতে ব্যথা পায়। কিন্তু উল্টো অভিযোগ তোলে যে, আমি নাকি আঙুলে আঘাত করে আহত করেছি। এই অভিযোগেই আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে’ বলছিলেন হেলেনা।

ভাষানটেক থানা পুলিশ নিয়মিত এই মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেয় উল্লেখ করে হেলেনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ ওই মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে। কারণ, থানায় নিয়মিত টাকা দেয় এই মাদক ব্যবসায়ীরা। তাদের টাকা খেয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে পুলিশ। পুলিশের শেল্টারেই আমাকে তারা মারধর করেছে। এই মারধরের কারণে আমি এখনও অসুস্থ। গতকালও (বৃহস্পতিবার, ২৪ মে) সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে আসছি।’

যাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই পুলিশ কর্মকর্তারা টাকা চাওয়া ও মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি— এগুলো সব মিথ্যে। বরং কামাল উদ্দিন ও হেলেনাই মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা যোগসাজশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ অভিযোগ করেছে। এ ব্যাপারে ভাষানটেক থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নূরুল ইসলামের ভাষ্য— ‘আমি কামাল উদ্দিনকে ধরে আনিনি। সাধারণ জনগণ তাকে মারধর করে পুলিশে দিয়েছে। টহল পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। তাকে নিয়ে আসার সময় আমি থানায় ছিলাম না, উত্তরায় ছিলাম। পরে থানায় আসার পর ঘটনা জানতে পারি। পরবর্তীতে যখন মামলা হয়, তখন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) না থাকায় আমি সই করি।’

কামাল উদ্দিনের পরিচয় সম্পর্কে পরিদর্শক (তদন্ত) নূরুল ইসলাম বলেন, ‘সে সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছিল। কামাল নিজে মাদক ব্যবসায়ীর সহযোগী। হেলেনাও মাদক বিক্রি করে।’ একলাখ টাকা চাঁদা দাবি ও মিথ্যে মামলা দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে ভাষানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সি সাব্বির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারা (কামাল ও হেলেনা) আরেক মাদক ব্যবসায়ী। যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে। আমি যতদূর জেনেছি, তারা আসামি। তাদের একজনকে জনগণ মারপিট করে পুলিশে দিয়েছে। আর হেলেনা, সে নিজে এলাকার একজনের আঙুল কামড়ে খেয়ে ফেলেছে। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করেছে।

‘আইজিপি কমপ্লেইন মনিটরিং সেলে’ পুলিশের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সহেলী ফেরদৌস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে যেই হোক অপরাধী হয়ে থাকলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। কোনও ব্যক্তির দায় পুরো পুলিশ বাহিনী গ্রহণ করবে না।’

বিশেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/ইলিয়াছ

Categories: অপরাধ ও দুর্নীতি

Leave A Reply

Your email address will not be published.