শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

বজ্রপাত আতঙ্কে কৃষি শ্রমিক সংকট

বিশেরবাঁশী ডেস্ক: পুরো হাওড় অন্ধকার করে বৃষ্টি। হঠাৎ হঠাৎ বিজলিও চমকাচ্ছে। এর মধ্যেই ক্ষেতের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে কৃষক আছকর আলী। ধান পেকে হলুদ হয়ে উঠছে। বন্যার শঙ্কাও উঁকি দিচ্ছে। তবু ফসল তুলতে পারছেন না শ্রমিক সংকটে। ঘন ঘন বজ্রপাত আতঙ্কে মাঠে যেতে চাইছেন না কেউ। দিরাইয়ের বরাম হাওড়ের এ কৃষকের কপালে তাই চিন্তার ভাঁজ। সঙ্গে ভয়ও, বজ্রপাতের।

গত বৃহস্পতিবার হাওড়ের কৃষক আছকর আলী বলছিলেন, ‘আমার নিজেরউ আওরো (হাওড়ে) নামতে ডর (ভয়) করে। আতখা কুনসময় ঠাডা (বজ্রপাত) পরি মরি যাই।’

বজ্রপাতের এ আতঙ্ক হাওড়জুড়েই। এর প্রভাব পড়েছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে। গত বৃহস্পতিবার দিরাইয়ের ধল সড়কে গিয়ে দেখা যায়, হাওড়ের মধ্যেই স্তূপ করে রাখা কাটা ধান। কিন্তু বাড়ি নিতে পারছেন না শ্রমিক সংকটে। টানা বৃষ্টিতে ঘন ঘন বজ্রপাত ও প্রাণহানির কারণে হাওড়ে যেতে চাইছেন না শ্রমিকরা। ফলে অনেক হাওড়ে পাকা ধান কাটতে পারছেন না কৃষক। অনেকে ধান কাটার পরও তা বাড়ি নিতে পারছেন না। হাওড়পাড়েই স্তূপ করে ফেলে রেখেছেন।

বজ্রপাত আতঙ্ক ভাবাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদেরও। সুনামগঞ্জের উপপরিচালক স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে জেলায় এবার বোরোর ভালো ফলন হয়েছে। তবে শ্রমিক সংকটে ধান কাটা ও মাড়াইকাজ ব্যাহত হচ্ছে। বজ্রপাতের কোনো পূর্বাভাস ও প্রতিরোধের উপায় জানা না থাকায় কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।

কয়েক বছর ধরেই আতঙ্কের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বজ্রপাত। এ দুর্যোগে প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে বজ্রপাতে সারা দেশে প্রাণ হারান ২১০ জন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ২৭৪। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫১। গত বছরও প্রাণ হারান ৩০৬ জন। আর এ বছর এখন পর্যন্ত বজ্রপাতের কারণে মৃত্যু হয়েছে ১৫৭ জনের।

সারা দেশেই কম-বেশি বজ্রপাত হলেও প্রাণহানির ঘটনা বেশি হাওড়াঞ্চলে। গত এক মাসে হাওড়বেষ্টিত সুনামগঞ্জেই মারা গেছেন ১৯ জন। উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি ঘটেছে হবিগঞ্জেও। বজ্রপাতের আতঙ্কও তাই হাওড়পাড়ের মানুষের মধ্যে বেশি। মেঘ দেখলেই কেউ আর ক্ষেতে যেতে চাইছেন না।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ঝাওয়ার হাওড়ের কৃষক মজম্মিল আলী বলেন, বজ্রপাতে প্রতিদিনই হাওড়ের বিভিন্ন স্থানে কেউ না কেউ মারা যাওয়ায় বাড়ির লোকও বৃষ্টির দিনে আমাদের হাওড়ে যেতে দিতে চায় না।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ মৌসুমে জেলার ১১টি উপজেলার ছোট-বড় শতাধিক হাওড়ে ২ লাখ ১৯ হাজার ২৯৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এ থেকে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫৯ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

অধিকাংশ ধান এরই মধ্যে ঘরে তুললেও ৩০ শতাংশ এখনো মাঠে রয়েছে। শ্রমিক সংকটে এ ধানও সময়মতো কাটতে পারছেন না কৃষক। দিরাই উপজেলার বরাম হাওড়ের কৃষক দিলীপ দাস বলেন, বজ্রপাতে লোক মারা যাওয়ায় হাওড়ের ধান কাটা নিয়ে বিপাকে পড়েছি। হাজার টাকা মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিক নিয়ে ক্ষেতে গেলেও মেঘ দেখলেই বাড়ির পথ ধরছে তারা। ২০ কেয়ার জমিতে আবাদ করে মাত্র ১৪ কেয়ারের ধান বাড়িতে এসেছে। এর মধ্যে বৃষ্টিপাত থাকায় অর্ধেক ধান পচে নষ্ট হয়ে গেছে।

জরুরি প্রয়োজনে বাড়তি মজুরিও সাধছেন অনেকে। তাতেও রাজি হচ্ছেন না শ্রমিকরা। জেলার তাহিরপুরের কৃষি শ্রমিক নুর জালাল বলছিলেন, আগে বাঁচতে হবে। পরে টাকা জোগাড় করা যাবে। হাওড়ে যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে ধান কাটতে যেতে ভয় করছে। এক-দেড় হাজার টাকা মজুরি দিলেও বিরূপ আবহাওয়ায় হাওড়ে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।

সুনামগঞ্জে হাওড়ের ২০ শতাংশ ধান কাটা এখনো বাকি বলে কৃষকরা জানালেও কৃষি বিভাগ বলছে, এখন পর্যন্ত হাওড়ের ৯০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। হাওড় বাদে অন্যান্য এলাকায় ধান কাটা বাকি আছে ২০ শতাংশের মতো।

এ ধান কেটে যাতে দ্রুত ঘরে তোলা হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বজ্রপাত আতঙ্ক, পেশা বদলসহ বিভিন্ন কারণে হাওড়ে ধানা কাটায় শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। কীভাবে এটা দূর করা যায়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

শ্রমিক সংকট ভাবিয়ে তুলেছে হবিগঞ্জের কৃষকদেরও। এ বছর বোরোর ভালো ফলন হলেও বজ্রপাতের কারণে শ্রমিক সংকটে ফসল ঠিকমতো কাটতে পারছেন না তারা।

জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের নিদনপুর গ্রামের কৃষক হীরামন সরকার আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ১০ বিঘা জমির মধ্যে সাড়ে তিন বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছি। বাকি জমির ধান শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারিনি। এরপর বৃষ্টিপাতের ফলে সাড়ে ছয় বিঘা জমির ধান সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

কৃষকের আশঙ্কা ফসল নিয়ে হলেও শ্রমিকের আতঙ্ক প্রাণ নিয়ে। উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ থেকে হাওড়ে ধান কাটতে আসা কৃষি শ্রমিক ফতেহ মিয়া বলছিলেন, আমরা ৩৫ জন বানিয়াচং উপজেলার পৈলারকান্দি গ্রামে কাজ করতে এসেছিলাম। কিন্তু বজ্রপাতের ভয়ে ২৫ জন আগেই বাড়ি ফিরে গেছেন। যারা রয়েছেন, তারাও বজ্রপাতের ভয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারছেন না।

দেশের শস্যভাণ্ডার খ্যাত চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার গুমাই বিলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক ধান রোপণ ও কাটতে আসেন। কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতের মাত্রা বাড়তে থাকায় ধীরে ধীরে কমে আসছে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শ্রমিকের সংখ্যা।

বাইরে থেকে এবারও যে কজন গুমাই বিলে বোরো ধান কাটতে এসেছেন, তাদের একজন নোয়াখালীর হাতিয়ার শ্যামল দাশ। তিনি বলেন, বজ্রপাতের কারণে বিলে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। চাহিদার চেয়ে কাজের লোক কম থাকায় এ বছর দৈনিক মজুরিও বেশি। শুরুতে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে তরুণদের কয়েকজন বাড়ি ফিরে গেছে। দিনের বেলা মাঠে কাজ করার সময় ঝড় ও বৃষ্টিপাত শুরু হলে আতঙ্কিত হয়ে অন্যরাও মাঠ ছাড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের বছরের চেয়ে শ্রমিক কম থাকায় এ বছর ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিকের দৈনিক মজুরিও ২০০ টাকার মতো বেড়েছে। গত বছর একেকজন কৃষি শ্রমিক দৈনিক ৮০০-৯০০ টাকা মজুরিতে কাজ করলেও এবার নিচ্ছেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা।

গত কয়েক দিনের বজ্রপাতে ঝিনাইদহে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে মাঠে যেতে ভয় পাচ্ছেন এ জেলার কৃষি শ্রমিকরাও। শ্রমিক সংকটে ধান নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন কৃষকরা। বাড়তি মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাচ্ছেন না অনেকে।

সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক দুদু মিয়া বলেন, এ বছর ধানের ভালো ফলন হয়েছে। তবে বজ্রপাতের কারণে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি মজুরিতে কখনো কখনো শ্রমিক পাওয়া গেলেও বৃষ্টি হলেই আর মাঠে থাকতে চাইছেন না তারা।

আশঙ্কাটা জেঁকে বসেছে কৃষি শ্রমিক টোকন মোল্লার মধ্যেও। তিনি বলেন, কদিন আগেই সদর উপজেলার বাজারগোপালপুরে বজ্রপাতে একজন মারা গেছেন। এ ভয়ে মেঘ দেখলেই আর মাঠে যাই না।

সদর উপজেলার ঘোড়শাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন পারভেজ মাসুদ লিল্টন। জনপ্রতিনিধি হলেও তার মূল পেশা কৃষি। ধান কাটতে শ্রমিক সংকটের কথা জানালেন তিনিও। এ জনপ্রতিনিধি বলেন, বর্তমানে শ্রমিক সংকটের কারণে মাঠ থেকে ধান কাটতে পারছি না। শ্রমিকদের বললে তারা বজ্রপাতের কারণ দেখায়। এতে ধান কাটা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

ফেনীতে গত কয়েক দিনের বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন পাঁচজন, যা কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই মাঠে যেতে চাইছেন না। যারা যাচ্ছেন, আকাশে মেঘ দেখলে তারাও দৌড়ে কাজ ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। এতে বিপাকে পড়ছেন কৃষকরা।

আমজাদ মীর নামে এক কৃষক বলেন, পাঁচ বিঘা জমির ধান কাটতে দৈনিক হিসেবে চারজন শ্রমিক নিয়েছি। গতকাল ধান কাটার কাজ শুরু করলেও সকাল ১০টার দিকে মেঘ দেখে কাজ ফেলে বাড়িতে চলে যান শ্রমিকরা। পরে ১২টার দিকে আবার ক্ষেতে যান তারা। বিকালে দুই দফা বিজলি চমকালে আবারো ক্ষেত থেকে উঠে যান তারা।

বিশেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/ইলিয়াছ

Categories: অর্থনীতি

Leave A Reply

Your email address will not be published.