শুক্রবার ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ শুক্রবার

‘মুখ ও মুখোশ’ নিয়ে কিছু কথা

রনজিৎ মোদক : আবদুল জব্বার খান বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কৃতিত্ব তাঁর। বলা হয়ে থাকে, আবদুল জব্বার খান বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ। তাঁর সম্মানে এফডিসিতে আবদুল জব্বার খান পাঠাগার নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পপুলার স্টুডিও দেশের তৃতীয় বেসরকারি চলচ্চিত্র স্টুডিও। ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ জেলা ফতুল্লার পাগলা এলাকায় স্থাপিত হয়। এই স্টুডিওটির প্রতিষ্ঠাতা দেশের ৩ জন বিশিষ্ট অগ্রগামী চলচ্চিত্রকর্মী। আবদুল জব্বার খান, এ আউয়াল ও মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ১৯৬৫ সালে স্টুডিওটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬ বিঘা জমির ওপর বিরাট পুকুর, বাড়ি, বাগান, গাছ-গাছালি নিয়ে এ স্টুডিও ছিল বেশ দৃষ্টিনন্দন। এতে তখনকার অনেক ছবির শুটিং, এডিটিং ও সাদাকালো ছবির প্রসেসিং করা হতো। আশির দশকের শেষদিকে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

আবদুল জব্বার খানের জন্ম ১৯১৬ সালে মুন্সিগঞ্জের মসদগাঁও গ্রামে। শৈশব থেকেই তার অভিনয়ের প্রতি ছিল দুর্বার আকর্ষণ। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় মঞ্চনাটক করতেন। ‘সতীর্থ’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘সোহরাব রোস্তম’, ‘বেহুলা’, ‘সমাজপতি’ প্রভৃতি মঞ্চনাটকে অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসিত হন, অর্জন করেন সম্মাননা। ১৯৪১ সালে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনয়ারিং স্কুল থেকে ডিপ্লোমা করে চাকরিতে যোগ দেন। পাশাপাশি চলতে থাকে নাট্যচর্চা। এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করেন ‘কমলাপুর ড্রামাটিক অ্যাসোসিয়েশন’। এই সংগঠন থেকেই ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘জাগালো দেশ’, ‘টিপু সুলতান’, ‘বঙ্গে বর্গী’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘ডাকাত’ প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ হয়।

পরবর্তী সময় ‘ডাকাত’ নাটক অবলম্বনে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ তৈরি করে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন আবদুল জব্বার খান। ‘মুখ ও মুখোশ’ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে আবদুল জব্বার খানের সাথে আরও অভিনয় করেছিলেন, নারায়ণগঞ্জের কৃতি সন্তান নাট্য ব্যাক্তিত্ব কাজী সিকান্দার।

আবদুল জব্বার খান চলচ্চিত্র বিষয়ক বেশ কিছু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা পপুলার স্টুডিও।

আবদুল জব্বার খান পরিচালিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘জোয়ার এলা’, ‘বাঁশরী’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘খেলারাম’, ‘উজালা’, এবং উর্দু ছবি ‘নাচঘর’। চলচ্চিত্র শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এসবের মধ্যে রয়েছে: বাচসাস পুরস্কার, এফডিসি রজত জয়ন্তী পদক, হীরালাল সেন স্মৃতি পুরস্কার, উত্তরণ পদক, বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক, ফিল্ম আর্কাইভ সম্মাননা প্রতীক, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সম্মাননা পদক, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি সম্মান পদক প্রভৃতি। ১৯৯৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর চলচ্চিত্রপ্রেমী প্রথিতযশা এই শিল্পী প্রয়াত হন।

 

আজকাল হলিউড আর বলিউড মুভির চাপে বাংলা মুভির নাজেহাল অবস্থা, কিন্তু কিছু কিছু বাংলা চলচ্চিত্রকে হলিউড আর বলিউড মুভির সাথে মেলানোটাই অযৌক্তিক। বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক্ চলচ্চিত্রটি হচ্ছে মুখ ও মুখোশ, বাংলাদেশে (তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) তৈরি বাংলা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র!!! কথাটা ভাবতেই দেহের রক্ত সঞ্চালনের হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা এবং চিত্রনাট্যকার আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। আবদুল জব্বার খানের নাটক “ডাকাত” হতে চলচ্চিত্রটির কাহিনী নেয়া হয়।

১৯৫৩ সালে আব্দুল জব্বার খান চলচ্চিত্রটির কাজ শুরু করেন। সে সময় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) নিজস্ব কোন চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠেনি। স্থানীয় সিনেমা হলগুলো ছিল কলকাতায় অথবা লাহোরে। পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজক এফ. দোসানির পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্যে ক্ষুদ্ধ হয়ে জব্বার খান চলচ্চিত্রটি নির্মাণে উদ্যোগী হন। আব্দুল জব্বার খান টানা দুই বছর ধরে ছবিটির কাজ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্থানীয় অভিনেতারা, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াাই বিনা পারিশ্রমিকে এই ছবিতে অভিনয় করেন। স্থানীয়ভাবে কোন ফিল্ম প্রোডাকশন স্টুডিও না থাকায়, ছবির নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য লাহোরে পাঠানো হয়। লাহোরের শাহনূর স্টুডিওতে ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিস্ফূটন কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৫৬ সালে ছবির কাজ শেষ হয় কিন্তু তিনি ছবিটি নিয়ে প্রথমে ঢাকায় ফেরার অনুমতি পাননি। ‘মুখ ও মুখোশ’র প্রথম প্রদর্শনী হয় লাহোরে। ঢাকায় ফিরে আসার পর ছবিটি প্রদর্শনীর বিষয়ে কোন প্রেক্ষাগৃহের মালিকের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়াও পাননি। তবে এ অবস্থা কাটাতে বেশি সময় লাগেনি।১৯৫৪ সালের ৬ই আগস্ট আবদুল জব্বার খান তার পরিচালনায় প্রথম সবাক্ চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর মহরত করেন হোটেল শাহবাগে। চলচ্চিত্রটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং খুলনায় একযোগে মুক্তি পায়। ছবিটির প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় রূপমহল প্রেক্ষাগৃহে। দেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসাবে দর্শকমহলে এটি নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয় ও প্রথম দফায় মুক্তির পর চলচ্চিত্রটি ৪৮,০০০ রুপি আয় করে।

চরিত্রসমূহ:-

ইনাম আহমেদ মুখ্য পুরুষ চরিত্র, আব্দুল জব্বার খান দ্বিতীয় প্রধান পুরুষ চরিত্র, পূর্ণিমা সেনগুপ্ত প্রধান নারী চরিত্র, জহরত আরা। (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর ছাত্রী), পিয়ারী বেগম। (তখন ইডেন কলেজের ছাত্রী), রহিমা খাতুন, বিলকিস বারী, আমিনুল হক (তখন ঢাকা বেতার কেন্দ্র-এ চাকুরীরত) ও নারায়ণগঞ্জের কাজী সিকান্দার ওরফে সিকান্দার আলী পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

কলাকুশলীবৃন্দ:-

চিত্রনাট্য বিপ্রদাশ ঠাকুর (কলকাতা), চিত্র গ্রহণ মুরারী মোহন (উপদেষ্টা ), পরে এই দায়িত্ব তুলে নেন সহকারী চিত্রগ্রাহক জামান, অঙ্গসজ্জা শ্যাম বাবু (আসল নাম শমসের আলী), সংগীতে কন্ঠ আবদুল আলীম এবং মাহবুবা হাসনাত, সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস, সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ধীর আলী, শব্দ গ্রহণ মইনুল ইসলাম ও সম্পাদক আব্দুল লতিফ (পশ্চিম পাকিস্তান) ।

ছবির প্রথম প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি ছিলেন শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ছবির মহরতে উপস্থিত ছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা। প্রথম শুটিং কালীগঞ্জে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। ছবির মহরত হয় ১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট। স্থান তখনকার শাহবাগ হোটেল। প্রথমে ছবির নাম রাখা হয়েছিল ‘ডাকাত’। পরে ফজল শাহাবুদ্দিনের পরামর্শে নাম রাখা হয় ‘মুখ ও মুখোশ’।
শুটিং শেষ হয় ১৯৫৫ সালের ৩০ শে অক্টোবর। শুটিংয়ের মূল স্থানগুলো ছিল সিদ্ধেশ্বরী, তেজগাঁও, রাজারবাগ, কামলাপুর, লালমাটিয়া, জিঞ্জিরা এবং টঙ্গীর বিভিন্ন জায়গায়।

চলচ্চিত্রটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং খুলনায় একযোগে মুক্তি দেয়ার পর টানা চার সপ্তাহ হাউজফুল চলেছিল ‘মুখ ও মুখোশ’। বুকিং শেষ হয়ে যাওয়ায় আর প্রদর্শন করা যায়নি। তবে এই একটি চলচ্চিত্র পূর্ব পাকিস্তানে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতার আবির্ভাব ঘটে। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ তাদের হাত ধরেই আসে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মোট ২২৪টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ঢাকায়। এর মধ্যে ১৬৫টি চলচ্চিত্রই বাংলা ভাষায় নির্মিত। এসময় বেশ কিছু কালজয়ী বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। আর এই যে বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশ, তার পেছনে নিঃসন্দেহে মুখ ও মুখোশের ভূমিকা রয়েছে।

অখন্ড পাকিস্তানের পূর্বাংশে একসময় পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রই নির্মিত হতো। প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব এমন চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তা বাস্তবায়ন করে দেখান আবদুল জব্বার খান। তাই তাকে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দিকপাল বলা যেতে পারে। তার নির্মিত ‘মুখ ও মুখোশ’ পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। সেই সময়ের নানান প্রতিকূলতা দিয়ে ছবিটিতে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও চলচ্চিত্রের পুরো দলের সদিচ্ছায় অক্লান্ত পরিশ্রমে ছবিটি সব দিক দিয়েই সফল ছবি হিসেবে গণ্য হবে। প্রায় অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ জয়ের এক অসাধারণ কাহিনী হিসেবে ‘মুখ ও মুখোশ’ বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ইতিহাস হয়ে থাকবে।

 

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

Categories: বিনোদন

Leave A Reply

Your email address will not be published.