শনিবার ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ ২০ এপ্রিল, ২০২৪ শনিবার

কবিতার বই “ব্লাড ফায়ার”

আবু সুফিয়ান খান: গদ্য কবিতা বিনির্মাণে নিবিষ্ট চিত্তের লেখক একজন কবি, দালান জাহান, কবিতা রচনায় তিনি সুদীর্ঘ সময়ধরে সাধনা করে আসছেন, তার লেখা কবিতা গুলো গদ্য রীতি-শৈলী ছন্দ চালে পর্ব বিন্যাস করে একটানা লেখছেন। নতুন কবিতার বই “ব্লাড ফায়ার” বইটির কবিতাগুলো পড়লেই পাঠক অবগত ও পরিচিত হবেন শব্দ চয়নের ব্যাপক অর্থবহ আধুনিক কলা কৌশল সম্পর্কে এবং মাধুর্যমণ্ডিত কাব্যিক কারুকাজ নিরূপনে। সমাজের কুহেলিকাময় অধ্যায় ও স্বধীনতা উত্তর অপ্রিয় কুৎসিত ঘটনাবলী সম্পর্কেও কবি লেখেছেন :
“শহরের নেংলা কুকুর গুলো
লেজ নাড়তে নাড়তে-
নিজেদের চিত্র আঁকছে
নিজেদের পায়ের কাছে
কবি তখন জায়গা ছেড়ে দিলো।”

– কবিতার নাম “ব্লাড ফায়ার”

এই কবিতার নামেই বইটির নাম করণ হয়েছে।
নাম করণের যথার্থতা যদিও কবিতায় আসে নাই তবু নামটির মধ্যে নতুনত্ব আছে এবং কবিতাটি গ্রন্থের নবমতম অবস্থানে স্থান পেয়েছে। এই কবিতার পূর্বে আরও ভালো কিছু কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। পুস্তকটির প্রথম কবিতার নাম “অনন্ত ঈশ্বরের কবিতা”:-
“আমার ভেতরে যে পাখি হেঁটে যায় নীরবে,
যে পাখিরা তোমার গানে বনবিহারী হলো,
সময়ের সমুদ্র থেকে
কিনে নিলো তিরিশটি বছর।
একখণ্ড সূর্য কণা,
অথবা ধারালো হীরার মতো ;
জাজ্বল্যমান নক্ষত্র এক,
সমগ্র বিশ্বের প্রচ্ছন্ন ঘুমে-
আবর্তনমুখী হলো,
এবং এঁকে দিলো শিল্প শহর।
প্রেমের আরেক নাম জীবন
অনন্ত ঈশ্বরের কবিতা,
দ্বিতীয়বারবের হলো
তোমার হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে,
তরপর থেকেই কবিতা হলো জীবন্ত।”

এরপর আরেকটি কবিতার নাম “সে এখন ঈশ্বরের কাছে যাবে”-
লোকটি উদ্বাস্তুর মতো ছুটছে
সমুদ্রের দিকে,
তার এক হাতে পৃথিবী
আরেক হাতে ধর্ম বিপ্লব,

নক্ষত্রলোকে সমুদ্রপানের মহা উৎসব।”

“নিঃশব্দ আগুন” কবিতায় কবি বলেছেন :-
“আনন্দ যোনি থেকে উলঙ্গিণী পায়ুপথ
বিভ্রম পাগলিলীর ধুলিজমা স্তন চেটে
জন্ম দিয়েছো ক্ষুধার্ত পঙ্গুশিশু,
যে শিশু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
তোমারই পথে,”

“বিদঘুটে অন্ধকার” কবিতার স্তবে কবি বলেছেন :-
ধরণীর উল্টোপিঠে ধর্মশূন্যতার বিদঘুটে অন্ধকার।”

কবি “কাগজের কঙ্কাল” কবিতায় বলেছেন,
আজ যারা মদের গ্লাস আর সঙ্গম জুসে ডুবে থাকো,
পঙ্গু স্বদেশ প্রেমের রাইফের কেড়ে-
ফণীমানসার অন্ধকারে ভরা হিস্টিরিয়ায় ভুগছ!
বিলাসি রমণীর মাংসল নিতম্ব হাতে,
অন্যপ্রান্তে বলে হ্যালো ইতিহাস,
যারা বদলে দিতে যাও উপবৃত্ত,
বদলাতে চাও স্বাধীনতার স্রোতধারা।”

বইটির শেষ কবিতাটি ” আমি বিপ্লব বুঝি না”
ভালোবাসা বুঝি শুধু ভালোবাসা বুঝি।”

প্রিয় পাঠক লক্ষ করেছেন কবি তার কাব্য রচনা শৈলী নির্মানে কোনরূপ কার্পন্য করেন নাই, ঋদ্ধহস্তে উপমা, রূপক কাব্য উপাদান ব্যবহার করেছেন, শব্দ প্রয়োগও করেছেন যথাযথভাবে। তবে বাক্যর অনুগামীতায় কিছুটা অসংগতি পরিলক্ষিত হয় এবং কাব্যরীতি অনুযায়ী অপ্রয়োজনীয় বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছ, যা বর্তমানে আধুনিক কবিতায় মানায় না।
কবিকে এ সব বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।
গদ্য কবিতার ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলেও পর্ব বিন্যাসে যতি, ছেদ, চাল আরো মাত্রাবৃত্তিক হওয়া শুদ্ধ।

চমৎকার উপমা, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা, রূপ-রূপক, ব্যঞ্জনাময় শব্দের বিন্যাস, কাব্যিক ছন্দ-পর্ব-রীতি-শৈলী ও সরল ঝংকারে সাবলীল বাক্য নির্মাণ, যাথোপযুক্ত উদাহরণসহ বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও উপাত্ত সম্বলিত এবং অজানা অনেক খুনসুটির অবতারণামূলক দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেম অন্তরালে বিষাদ রসময় সহজপাঠ্য, প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা ৮০ টি কবিতা।
লেখকের মেধা ও মনন সুপরিচ্ছন্নভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। অন্তমিলের নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলো চা-এ চুমুক দিতে দিতে বা রিক্সা-বাসে চলতে চলতে পড়ে শেষ করা সম্ভব। পড়ার জন্য আলাদা সময় করে নেয়া প্রয়োজন নাই। গদ্য রীতির কবিতাগুলোও হোঁচট খাওয়ার মত নয়। তবে পুরোপুরি আধুনি নির্মাণ শৈলী কবিতার গায়ে বসাতে কবি চেষ্টা করেছেন।
বইটিতে বাড়তি পাওনা আছে, কিছু অন্তমিলের কবিতাও কবি লিখেছেন :
“একুশের কবিতা, নারী, স্বধীনতার স্বাধীনতা, একান্নবর্তী, ” ইত্যাদি। তবে “স্বাধীনতার স্বাধীনতা” কবিতার স্তবে
স্বাধীনতা বলতে এখনও
খাণ্ডবদাহনকেই চিনি
স্বাধীনতা বলতে এখনও
শবাগারের গন্ধকেই জানি।”
এখানে অন্তমিলে ‘চিনি’এবং ‘জানি’ অন্তমিল রীতিশুদ্ধ হয় নাই। কবিকে অবশ্যই অন্তমিলের শুদ্ধ রীতি-নীতি জানতে হবে।

পাঠান্তে কবিতা কেমমন হয়েছে, তাও পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন। কবি লিখতে যেয়ে ইংরেজি শব্দের প্রভাব এড়াতে পারেন নাই, তিনি বইর নামটিও ইংরেজি শব্দ দিয়েছেন, বেশ কয়েকটি কবিতার নামও ইংরেজি শব্দে দিয়েছেন যেমন – লাইট হাউজ, সুইচ হার্ট হাউজ, ওয়াশিংটন পোস্ট, কমরেড, এবং কবিতার ভেতরেও অনেক ইংরেজি শব্দ অবিকৃত অবস্থায় প্রয়োগ করেছেন, তাতে পড়তে বুঝতে বা ছান্দিক দোলায় কবিতার মান ক্ষুণ্ন হয় নাই বরং বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এখানে কবি তার শব্দ প্রয়োগের বাড়তি দক্ষতা দেখিয়েছেন।
বইটি সকল মানুষের পাঠযোগ্য ও সংগ্রহে সংরক্ষণযোগ্য।
বানান বিভ্রান্তি ( রূপালী, চিকুনগুনিয়া, রূপক, কারণ) পরিলক্ষিত হয়, তবে ছাপাত্রুটিও নাই।
৫ ফর্মার বই, সুন্দর আকর্ষণীয় চার রঙের প্রচ্ছদ ও মজবুত বাঁধাই। ৮০ গ্রাম কাগজ, ১/৮ সাইজ। মূল্য টাকা ১৭০.০০ মাত্র।

কবি দালান জাহান

প্রকাশক: বলাকা প্রকাশন, বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সম্পাদক শরীফা বুলবুল।
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর।
স্বত্ব : লেখক।
কবির কাব্যচর্চা অব্যাহত থাকুক।
বইটির বহুল প্রচার ও সফল বিক্রয় কামনা করি।

 

লেখক: কবি, সমালোচক, মুক্তিযোদ্ধা।

Categories: খোলা বাতায়ন,সাহিত্য

Leave A Reply

Your email address will not be published.