শুক্রবার ১৫ চৈত্র, ১৪৩০ ২৯ মার্চ, ২০২৪ শুক্রবার

যে কারণে সুপ্রিম কোর্ট বারে আ. লীগ সমর্থিত প্যানেলের হার

বিষেরবাঁশী ডেস্ক: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (সুপ্রিম কোর্ট বার) নির্বাচনে আওয়ামীপন্থী আইনজীবী প্যানেলের ভরাডুবির কারণগুলো জানতে পেরেছে অনুসন্ধান কমিটি। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গঠিত পাঁচ সদস্যের এ অনুসন্ধান কমিটি অন্তত ২০ জন আইনজীবীর সঙ্গে বৈঠক করে হারের কারণ তুলে আনার চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের এ অনুসন্ধান কমিটি যেসব আইনজীবীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে কারণগুলো জানতে পেরেছে বাংলা ট্রিবিউন।জানা গেছে, কারণগুলো যাচাই-বাছাই ও প্রতিবেদন আকারে তৈরি করছে অনুসন্ধান কমিটি। শিগগিরই তা শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৮-২০১৯ সেশনের নির্বাচনে ১৪টি পদের মধ্যে ১০টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল।
গত ৩১ মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সর্বসম্মতভাবে দলের কোন্দল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপুমনি ও আব্দুর রহমানসহ পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দেন শেখ হাসিনা। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে হারের কারণগুলো খুঁজে বের করে প্রতিবেদন জমা দিতেও নির্দেশ দেন তিনি।
জানতে চাইলে অনুসন্ধান কমিটির প্রধান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস করেন এমন অনেক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে বারের নির্বাচনে হারের কারণগুলো তুলে আনার চেষ্টা করেছি।’ তিনি বলেন, ‘এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই হারের কারণ প্রতিবেদন আকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হবে। ’হারের যত কারণ
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে হারের যেসব কারণ পাওয়া গেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো আওয়ামী লীগের সিনিয়র আইনজীবীদের বিরোধিতা, নতুন আইন কর্মকর্তা নিয়োগে বিরূপ প্রভাব, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন কর্মকর্তাদের অতিমাত্রায় প্রচারণা, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী দুজনের ব্যক্তিগত সমস্যা, ভোটের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়, নির্বাচনি প্রচারণায় থাকা আইনজীবী নেতাদের সক্রিয় না থাকা এবং অন্য আইনজীবী নেতাদের ভূমিকা ও আঞ্চলিক ভোট ভাগাভাগি। এসব কারণেই ভোটে হারতে হয়েছে আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবী প্যানেলকে। অনুসন্ধান কমিটির মুখোমুখি হওয়া আইনজীবীদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদার অসহযোগিতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের একীভূত হওয়া মানতে পারেনি। তিনি নবগঠিত বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’ হিসেবে ট্রিট করেন। ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন দ্বিতীয় দফায় সভাপতি নির্বাচিত হোক তা-ও চাননি বাসেত মজুমদার। এবারও নির্বাচনে বাসেত মজুমদারের উক্তি ছিল ‘হুতায়ে দাও’। সবশেষ অফিসার্স ক্লাবে একটি ডিনার অনুষ্ঠানে তাকে সভাপতিত্ব করতে না দেওয়াও তার ঈর্ষার কারণ। জানা গেছে, অনুসন্ধান কমিটি আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক স.ম. রেজাউল করিমের বিরুদ্ধেও অভিযোগ পেয়েছেন। আবার সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের তাকে পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ও পরাজয়ের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, এবারের নির্বাচনে তিনি ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে সভাপতি প্রার্থী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের পক্ষে এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোরশেদের বিপক্ষে কাজ করেন। অনুসন্ধান কমিটি অভিযোগ পেয়েছেন অ্যাডভোকেট লায়েকুজ্জামান মোল্লার বিরুদ্ধেও। তিনি ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেননি। তিনি সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। লায়েকুজ্জামান নির্বাচনে সাদা দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধিতা করেছেন।
অনুসন্ধান কমিটি জানতে পেরেছে, অ্যাটর্নি জেনারেল ও অন্যান্য আইন কর্মকর্তা নির্বাচনে ভীষণ সক্রিয় ছিলেন। তাদের ভূমিকা আদালতে বরাবরই সরকারের পক্ষে থাকায় সাধারণ ভোটাররা আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের ভোট দেননি। অবশ্য দায়িত্বের অংশ হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন কর্মকর্তাদের কোর্টে সরকারের পক্ষে দাঁড়াতে হয়। এসব কারণে তারা সাধারণ আইনজীবীদের কাছে প্রিয়মুখ নন।
নির্বাচনের মাত্র অল্প কয়েকদিন আগে কোর্টে নতুন আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি অনেক আইন কর্মকর্তা সরকার নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু জেলা কোর্টের আইনজীবীদের সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। আইন কর্মকর্তা নিয়োগের বেলায় তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এছাড়া বরিশাল ও বৃহত্তর ফরিদপুরের আইনজীবীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্প্রতি আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে।
প্রার্থী হিসেবে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। একইভাবে আওয়ামী আইনজীবী সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মোর্শেদ অন্য আইনজীবীদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য নন। যদিও আইনজীবী হিসেবে তার খ্যাতি আছে।
সিনিয়র আইনজীবীদের কেন্দ্র করে ভোটের দিন ফটোসেশনও নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। নারী আইনজীবীরা সারাক্ষণ সেলফি ও ফটোসেশনে ব্যস্ত থাকেন ভোট চাওয়ার পরিবর্তে। তারা নিজেরাও সাধারণ ভোটারদের কাছে ভোট চাননি এবং সিনিয়র নেতাদের ভোট চাওয়ার সুযোগ দেননি। এছাড়া মামুন মাহাবুব, রবিউল আলম বুদু, আবু সাঈদ সাগর, বশির আহমেদ নেতৃবৃন্দ ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বকে বিরোধিতা করেছেন। আউসাফুর রহমান বুলু সিনিয়র অ্যাডভোকেট বাসেত মজুমদারের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি। তিনি খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও খুলনা বার ও নিজ জেলার বার বাগেরহাটে তার জনপ্রিয়তা নেই। তিনি ব্যারিস্টার তাপসকে সহযোগিতা করার ভান করেছেন মাত্র, আদতে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। আজহারুল্যা মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এছাড়া পঞ্চগড়ের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম সুজন ও মাহাবুব আলীও নানা কারণে বিরোধিতা করেছেন বলে অনুসন্ধান কমিটিকে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
খালেদা জিয়ার রায়ও বারের নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। খালেদার জামিনের আবেদনে বিরোধিতা সাধারণ আইনজীবীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে। আইনজীবী ইয়াদিয়া জামানকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলে মনোনয়ন দেওয়াও হারের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। তিনি সদ্যবিদায়ী বিচারপতি মানিকের জন্য বিতর্কিত ছিলেন। তাই তাকে মনোনয়ন দেওয়া সাদা প্যানেলের জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল।
প্রসঙ্গত, গত ২১ ও ২২ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট নেওয়া হয়। সমিতির ২০১৮-২০১৯ সেশনের নির্বাচনে ১৪টি পদের মধ্যে ১০টি পদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে বিএনপি সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের নীল প্যানেল। এই নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের সাদা প্যানেল।
বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল থেকে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ৫৪ ভোট বেশি পেয়ে আবারও বিজয়ী হন। তার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ২ হাজার ৩৬৯টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেলের অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ২ হাজার ৩১৫টি।

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/মিতু

Categories: রাজনীতি

Leave A Reply

Your email address will not be published.