মঙ্গলবার ৫ চৈত্র, ১৪৩০ ১৯ মার্চ, ২০২৪ মঙ্গলবার

আর কিছুই তো করতে পারিনি শুধু বই কিনি আর লিখি

সদ্যই মারা গেলেন ড. করুণাময় গোস্বামী। এ দেশের অন্যতম প্রধান এই সংগীত গবেষক ও শিক্ষাবিদের এটিই হয়তো শেষ সাক্ষাৎকার। এখানে তিনি তাঁর ছেলেবেলা, কর্মজীবন ও গবেষণার ভুবনটি তুলে ধরেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওমর শাহেদ। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান :

গানের প্রতি এই ভালোবাসা কিভাবে হলো?

আমার জন্ম ময়মনসিংহ জেলার গোঁসাই চান্দুরা গ্রামে, ১৯৪৩ সালের ১১ মার্চ। বাবা রাসবিহারী গোস্বামী, মা জ্যোত্স্না রানী দেবী। পিতৃগৃহটি অসম্ভব সাংস্কৃতিক গৃহ ছিল। জ্যাঠা মশাই কবি, গায়ক ও পণ্ডিত ছিলেন। বাবা গাইতেন না, অভিনয়পাগল ছিলেন, নাট্য সংগঠনে তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। গ্রামে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ, মণ্ডপ ছিল। সেখানে বসে মানুষ নাটক দেখত। গোঁসাই চান্দুরা সাংস্কৃতিক গ্রাম ছিল। সারা বছর ধরে প্রতিদিন, প্রতি রাতে কোনো না কোনো বাড়িতে, বিশেষত আমাদের বাড়িতে যাত্রা, নাটক, পদাবলি কীর্তন, নামকীর্তন, নগরসংকীর্তন হতো। বাবার মা, মানে আমার পিতামহী ইন্দ্রমণি দেবী কবি, গায়িকা ছিলেন। গান, নাটক, যাত্রায় অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। শুধু ছেলেদেরই নয়, মেয়ে, বয়স্কদেরও জড়ো করে তিনি এগুলো আয়োজনের ব্যবস্থা করতেন। পুরো ময়মনসিংহ জেলার কবি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে কারণে বাবা, জ্যাঠামশাই নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সঙ্গেও তাঁদের পরিচয় ছিল। এখনো মনে আছে, প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ২ তারিখে আমাদের বাড়িতে কবিগান হওয়ার পর গোঁসাই চান্দুরা গ্রামে কবিগান শুরু হতো। গ্রামে হরিগান, মেটে হরিগানের মতো বাংলার লোকসংগীত, আধা-লোকসংগীত, রাগসংগীতের মাঝামাঝি ফর্মগুলো হতো। তখন হিন্দুস্তানি গানের ওস্তাদরা ময়মনসিংহের গৌরীপুর, কালীপুর, রামগোপালপুর, কৃঞ্চপুর, আঠোরোবাড়ীসহ বিভিন্ন গ্রামে থাকতেন। এগুলো আমাদের গ্রাম থেকে কাছেই ছিল। ফলে হিন্দুস্তানি দরবারি গানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল, ওস্তাদদের কাছ থেকে গোঁসাই চান্দুরা গ্রামের সংগীত উৎসাহীরা কিছু না কিছু শিখে, শুনে আসতেন। সেটির প্রভাব গ্রামের সংগীত, নাট্যচর্চায় পড়ত। অতি শৈশবে জমিদার বাড়ি থেকে সেতারি, বেহালাবাদক, নর্তক-নর্তকীদের গ্রামে আসতে দেখেছি। তাঁরা নানা পরিবেশনা করতেন। ছোটবেলায় আমি খুব ভালো গান করতাম। ফলে খুব সমাদর পেতাম। মামা পবিত্রকুমার গোস্বামীর কাছে গান শিখতাম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই গান-বাজনার ভেতরে বড় হতে থাকি।

ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে?

আমার জন্মের কাছাকাছি সময়ে বাংলায় মহাদুর্ভিক্ষ হয়। খুব কম বয়স থেকেই দুর্ভিক্ষের কথা শুনতাম। গ্রামের লোকেরা দুর্ভিক্ষের কবলে না পড়লেও গরিব শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়েছে শুনেছি। একটু বড় হয়ে শুনলাম, কলকাতায় ৪৬-এ দাঙ্গা হয়েছে। তখনো তেমন বুঝি না। দাঙ্গায় গ্রামের তিন-চারজন রোজগারি মানুষ মারা যান। পরিবার নিয়ে যাঁরা কলকাতায় ছিলেন, ফিরে এলেন। আশপাশের গ্রামেরও কয়েকজন মারা গেলেন। সরকার বাড়ির বড় ছেলে শিয়ালদহ রেলস্টেশনে কাজ করতেন, মারা যান। তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা ফিরে আসে। তাঁর ছেলেদের কারো কারো সঙ্গে প্রাইমারি পড়েছি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরপরই আমাদের গ্রামটি ভেঙে যেতে শুরু করল। এটি আমার শৈশবের কথা। যে প্রকাণ্ড সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি, সেটি লুপ্ত হতে লাগল। কয়েক বছরের মধ্যে গ্রামটি ভেঙে গেল।

লেখাপড়া?

গ্রামের গোঁসাই চান্দুরা প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাইমারি, পাশের গ্রামের বাহাদুরপুর স্কুল থেকে প্রবেশিকা, কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে কলেজ পাস করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে ইংরেজিতে এমএ পাস করেছি। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা কাব্যের গীতিধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’ বিষয়ে পিএইচডি করেছি।

কর্মজীবন?

১৯৬৪ সালের শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জের উত্তরায়ণ কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। আসলে পরিকল্পনা করে শিক্ষকতায় আসিনি। পাস করার সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারিতে ঢুকে গেছি, আর বেরোতে পারিনি, ইচ্ছাও করেনি। চাইলে ওকালতি, সিভিল সার্ভিস বা বিদেশে যেতে পারতাম, যাইনি। ১৩-১৪ বছর সেখানে কাজ করার পর কলেজটি সরকারি হয়ে গেল। ফলে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত হলাম। ধীরে ধীরে পদোন্নতি হলো এবং নারায়ণগঞ্জ মহিলা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে গেলাম। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিতে সংগীত, কোনোটিতে ইংরেজি বা কালচারাল হিস্ট্রি পড়িয়েছি। ২০০৫ সালে ক্যামব্রিয়ান কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দিয়েছি।

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?

৫২-৫৩ বছর ধরে পড়াচ্ছি, চোখের সামনে দেখছি শিক্ষা কোন দিকে যাচ্ছে, উন্নতি অনেক হয়েছে, আরো অনেক উন্নতি হওয়া দরকার। সবার আগে গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষায় আরো অনেক গতি সঞ্চার করা প্রয়োজন। আরো অনেক বেশি প্রাথমিক স্কুল প্রয়োজন, অনেক সুবিধা প্রয়োজন। অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন। স্কুল ভবন, ক্যাম্পাস আরো ভালোভাবে তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা— ব্রিটিশ মডেলের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যে নানা গতি-প্রকৃতি আছে সেগুলোকে এক করে, অভিন্ন সিলেবাস, অভিন্ন বেতন স্কেল, অভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা না-ই বললাম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইউজিসির আরো সুপারভিশনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে সিলেবাস উন্নত, আপটুডেট করা প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে বেদনাদায়ক মনে হয়, আমাদের এখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত শিক্ষকের খুব অভাব। ভালো ছাত্র-ছাত্রী আছে, তাদের পড়ানোর প্রস্তুতিও আছে, তবে ভালো শিক্ষক নেই। এই ভয়াবহ অভাবটি যেভাবেই হোক পূরণ করতে হবে। শুধু বিদ্বান হলেই হবে না, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রভাবিত করতে পারেন এমন মন ও চরিত্র শক্তিসম্পন্ন শিক্ষক প্রয়োজন। সিলেবাস পড়ানো খুব বড় ব্যাপার নয়, ঘরে বসেও মা-বাবা বা অন্যদের সাহায্য নিয়ে সিলেবাস শেষ করা যায়, আজকাল অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। শিক্ষকের চরিত্র বল, বিদ্যা, জীবনযাপন, জীবনস্বপ্ন দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা না থাকলে সমাজের উন্নতি হবে না। একজন ভালো শিক্ষকের সংস্পর্শে আসার মানে হলো, আগুনের সংস্পর্শে আসা, উতপ্ত হয়ে ওঠা। বিদেশে গেলে বাংলাদেশের অনেক ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথা হয়। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যালের এই মেধাবীরা বলে, আমার জীবনে প্রভাব ফেলেছেন এমন কোনো শিক্ষকের কথা মনে পড়ে না স্যার। এটি আমার কাছে হাহাকারের মতো মনে হয়।

ব্যক্তিগত জীবন?

বিয়ে করেছি ১৯৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। স্ত্রী শিপ্রারানী গোস্বামী দর্শনের অধ্যাপক, এখন অবসরে আছে। ছেলে সায়ন্তন গোস্বামী প্রকৌশলী, কানাডায় আছে। মেয়ে তিথি গোস্বামী এখান থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আছে।

গান শেখা?

ছোটবেলায় মামা পবিত্রকুমার গোস্বামীর কাছে গান শিখতাম। পরে দীর্ঘদিন ওস্তাদের কাছে শেখা হয়নি। নিজে গেয়েছি, কিছু যন্ত্র বাজাতে শিখেছি। কলেজে চাকরি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে গান শিখতে আরম্ভ করলাম। নারায়ণগঞ্জের খুব গুণী শিক্ষক নিত্যগোপাল সাহা তখন বাফায় গান শেখাতেন। তাঁর কাছে শিখেছি। পরে আবদুল আজিজ খান, ইয়াসিন খানের কাছে শিখেছি। শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতন থেকে ঢাকায় এলে তাঁর কাছেও কয়েকটি শেখা গান গেয়ে ঠিক করে নিয়েছি। ওয়াহিদুল হক ভাই বছরে বেশ কয়েকবার আমার নারায়ণগঞ্জের বাসায় এসে তিন-চার দিন থাকতেন। তাঁর কাছেও রবীন্দ্রনাথ, ডিএল রায় বা অতুলপ্রসাদের গান মিলিয়ে নিতাম। নিজে গায়ক হব বলে গান শিখিনি, কখনো রেডিও-টিভিতে গাইনি। গানের ওপর লিখব বলে, গান বুঝব বলে গান শিখেছি। পাশ্চাত্য সংগীতও খুব যত্ন করে শিখেছি। তখন সেবাস্তিয়ান পেরেইরা নামের একজন শ্রীলঙ্কান মিউজিশিয়ান ঢাকায় থাকতেন। ছাত্র-ছাত্রী নেই, ফলে তিনি বেশ অর্থকষ্টে পড়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু রোডের চার্চে যেতেন, সেখানেই পরিচয়। দুই বছর সপ্তাহে দুই দিন তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। খুব ভালোভাবে নোটেশন শিখেছি, ওয়েস্টার্ন মিউজিকের মুভমেন্ট, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো খুব ভালোভাবে বুঝে নিয়েছি। পরে এই শিক্ষা খুব উপকারে লেগেছে। নজরুলের ওপর ইংরেজিতে বই লেখার সময় আমি স্টাফ নোটেশনে তাঁর ১৭টি নতুন রাগের আরোহ, অবরোহ দিতে পেরেছি। পেরেইরা আমাকে সাহায্য করেছেন।

লেখালেখির শুরু?

গানের চৈতন্য তো ছোটবেলায়ই পেয়েছি। সে আকাঙ্ক্ষা হয়তো মনে থেকে থাকবে। সে থেকেই গান নিয়ে লেখার ঝোঁক। ১৯৬৫ সাল থেকে দৈনিক সংবাদে রবীন্দ্রনাথের ওপর ধারাবাহিক লিখতে লাগলাম। সঙ্গে সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করলাম। শুরুতে আগ্রহের বিষয় ছিল আফ্রিকার গল্প, কবিতা, লাতিন কবিতার অনুবাদ, আধুনিক লাতিন কবিতার ইতিহাস। অনেকটাই এগিয়েছি। ১৯৬৫ সাল থেকে ভেতরে ভাবনা এলো, সংগীতের অভিধান ‘সংগীতকোষ’ তৈরি করব। সেখানে ভারতবর্ষের সংগীত, বাংলা গানই শুধু নয়, সারা পৃথিবীর, বিশেষত ওয়েস্টার্ন ও কিছু আফ্রিকান ফর্মও কাভার করব। ওয়াহিদ ভাই শুনে বলেছিলেন, ‘তুমি কী পাগল হয়ে গেলে? এ কী একার কাজ? এত বড় কাজ কি কোনো মানুষ করতে পারে? এটি করবেই বা কিভাবে? এ তো অসম্ভব। ’ যেই শোনে, অবাক হয় (হাসি)। কিন্তু কী যে পাগলামো পেয়ে বসল! ডিকশনারি অব ওয়ার্ল্ড মিউজিক তৈরির জন্য ১৯৬৫ সাল থেকে ঈশ্বরের ৩৬৫ দিন এ বিষয়ে প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়েছি, লিখেছি। অনেক বইপত্র সংগ্রহ করেছি। নারায়ণগঞ্জের ঢাকেশ্বরী মিল এলাকা গান-বাজনার চমৎকার জায়গা ছিল। সেখানে অনেক গুণী যন্ত্রী, ভালো সংগীত শিক্ষক, সংগীতজ্ঞ থাকতেন। তাঁদের একজন, পুরো নাম মনে নেই—চক্রবর্তী মহোদয় একদিন বললেন, ‘আর মিল এলাকায় থাকতে পারছি না, আমার সারা জীবনের সংগীত গ্রন্থ সংগ্রহ আপনাকে দিয়ে যাই?’ তিনি বিশাল সংগ্রহ দিলেন, সামান্যই দাম শোধ করেছিলাম। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তখন পয়সাকড়িও ছিল না, অল্প বেতনের চাকরি করতাম। বিনয় বর্মণ নামের নারায়ণগঞ্জের এক বিখ্যাত উকিল তিনটি আশ্চর্য কালেকশন—‘দেশ’, ‘লাইফ’ ও ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের শুরু থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চামড়ায় বাঁধানো প্রতিটি ভলিউম দিয়েছিলেন। নিজে কিনেছি, কাজ করব শুনে নানাজন এটি নিন, ওটি নিন—এভাবে সাহায্য করেছেন, বিশাল সংগ্রহশালা গড়েছিলাম। তখন থেকে সংগীতকোষ, আফ্রিকার গল্প-কবিতা অনুবাদ, লাতিন কবিতার অনুবাদ শুরু করলাম। সেই সঙ্গে ছিল বোদলেয়ারের ইনটিমেট জার্নালসের অনুবাদ। (হাসি) এখন ভাবলে অবাক লাগে, চাকরি, বাজার-হাট, সব কিছুর বাইরে গিয়ে এত কাজ একসঙ্গে কিভাবে শুরু করেছিলাম! সেই কাজের ফলেই ১৯৭২ সালে প্রথম বই বেরোলো—‘কিশোর সংগীত’। কাইয়ুম চোধুরী কাভার করে দিলেন, ‘বর্ণমিছিল’ থেকে প্রকাশিত হলো। এটি সংগীত অভিধানের অতি সংক্ষিপ্ত শিশুতোষ রূপ। সংগীতের মৌলিক ধারণাগুলো আছে। তাতে আমার খুব উপকার হলো, সংগীতকোষ কী রকম হবে অনুমান করতে পারলাম। এরপর ‘আফ্রিকার গল্প’, ‘আফ্রিকার কবিতা’ প্রকাশিত হলো। তবে লাতিন আমেরিকার কবিতার যে বড় অনুবাদটি লিখেছিলাম সেটি মুক্তিযুদ্ধে লুটপাটের পর অন্য কাজে জড়িয়ে যাওয়ায় আর লিখতে পারিনি। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে ‘উত্তরাধিকার’-এর ঢাউস সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তাতে বোদলেয়ারের পুরো অনুবাদটি ‘বোদলেয়ারের অন্তরঙ্গ ভাবনাবলি’ নামে প্রকাশিত হয়। বইয়ে প্রকাশের সময় এটির নাম ‘বোদলেয়ারের অন্তরঙ্গ ডায়েরি’ দিয়েছি। সংগীতকোষসহ গল্প-কবিতা অনুবাদের কাজ অনেকখানি এগিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, নারায়ণগঞ্জের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি হয়ে, ভারতে শরণার্থী হয়ে চলে গেলাম। ফিরে এসে দেখি, সব লুট হয়ে গেছে, একটি বইও নেই। হারমোনিয়াম, লাহোর থেকে কেনা চমৎকার তানপুরাও লুট হয়েছে। ধৈর্য ধরে বই সংগ্রহ করে আবার কাজ শুরু করলাম। তখনই মনে হলো, নজরুলের ওপর কাজ করা প্রয়োজন। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকেই সিরিয়াসলি তাঁর ওপর কাজ শুরু করলাম। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব ভাই বললেন, ‘আমার এখানে নজরুলের ওপর তোমার লেখা ধারাবাহিক ছাপাও। ’ বিশেষত নজরুলের গান নিয়ে লেখা শুরু করলাম। তাঁর গানের সৌন্দর্য ও উপযোগিতার দিক বিচার করে, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুদ্র মানসিকতা, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ—এসবের ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য তাঁর প্রবল প্রেরণাকে আশ্রয় করে তাঁর গান নিয়ে লেখা শুরু করলাম। এরপর নজরুল গবেষণার জন্য বাংলা একাডেমি বৃত্তি পেলাম। ১৯৮৭ সালে পিএইচডি শেষ করলাম। সে বছরই নজরুল গবেষণার জন্য সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার ‘নজরুল পুরস্কার’ পেয়েছি। বাংলা একাডেমি থেকে ‘নজরুল গীতিপ্রসঙ্গ’ নামে প্রকাশিত বইটি আমার পিএইচডির বিস্তারিত বিবরণ। তাতে থিসিসের বিষয়ের বাইরে আরো বহু বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা আছে।

আপনার পিএইচডির বিষয়ও তো নজরুল?

‘বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’ অভিসন্দর্ভে বাংলা কাব্যগীতিতে নজরুলের অবদানের স্বরূপ বিচারের চেষ্টা করেছি। বলা যায়, খুব সফলভাবেই কাজটি করেছি। নজরুল গজল প্রবর্তন করেছেন, আধুনিক বাংলা গানের সূচনার যুগটি গড়ে দিয়েছেন। আধুনিক বাংলা গানকে রূপ-রসের মধ্যে নিয়ে এসেছেন। সিনেমা, রেকর্ডে গান করেছেন। দেশাত্মবোধকে সম্পূর্ণ নতুন সংগ্রামের মাত্রা দিয়েছেন। খুব সাম্যবাদী ছিলেন, শোষণবিরোধী অনেক গান আছে। সাধারণের অধিকার, সর্বহারার উত্থান ও জয় কামনা করে অনেক গান লিখেছেন। এগুলো বাংলা গানে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে বাংলা গানের ইতিহাসে তিনি ঐতিহাসিক স্থান করে নিয়েছেন। সেগুলোই চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।

কবি নজরুলকে নিয়ে আরো অনেক কাজ করেছেন…

‘নজরুল সংগীতের জনপ্রিয়তার স্বরূপ সন্ধান’ নামে আমার বই আছে। নজরুল ইনস্টিটিউট তৈরির পর সেখান থেকে ‘আসপেক্টস অব নজরুল সংস’ নামে নজরুলের গান নিয়ে বই প্রকাশ হলো। তাতে তাঁর গানের নানা দিক তুলে ধরেছি। পরে লিখেছি ‘ইন্ট্রোডিউসিং কাজী নজরুল ইসলাম’। রেকর্ড হওয়া তাঁর প্রায় এক হাজার ৪০০ গানের তালিকা করে ‘নজরুল সংগীতসূচি’ প্রকাশ করেছি। ইংরেজিতে নজরুলের জীবনী লিখেছি—‘কাজী নজরুল ইসলাম : আ বায়োগ্রাফি’। আড়াই শ, পৌনে তিন শ পাতার এই বইটি তাঁর একমাত্র ইংরেজি জীবনী। এটি খুব প্রয়োজনীয় কাজ। যখন যা করেছি, প্রয়োজন বুঝেই করেছি। জনপ্রিয় হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়, আশায় কোনো কাজ করিনি। মানুষের জন্য কাজটি করার দায়িত্ব বোধ করেছি, যখনই করলে ভালো হবে ভেবেছি, করেছি। আমার সব কাজই বড়, কোনো ছোট কাজ নেই। নজরুলের কাজ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ শুরু করেছি।

তাঁকে নিয়ে কী লিখেছেন?

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত প্রথম বই ‘রবীন্দ্র সংগীত পরিক্রমা’র কাভার করেছিলেন কাইয়ুম ভাই। রবীন্দ্রনাথের নানা ধরনের গান নিয়ে কেন কাজ করেছি—এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বার্ণিক রায় নামের এক সমালোচক আছেন। তাঁর নাট্যসংগীতের একটি বই বিশ্বভারতীতে পড়ানো হতো। সেখানে তিনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য, নাট্যসংগীতের ওপর ভাগনার নামের এক জার্মান সংগীত পরিচালকের খুব প্রভাব আছে। ভাগনার রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বড় সংগীত রচয়িতা। তিনি বারবার ভাগনারের কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ভাগনারের ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারবেন না—এ কথাগুলো আমার কাছে খুব আপত্তিকর মনে হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা এগুলো পড়ছে। এটি খণ্ডানো প্রয়োজন বলে মনে হলো। ভাগনার পাশ্চাত্য ধারার, রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যের। ভাগনার ইনস্ট্রুমেন্টাল (যন্ত্রসংগীতনির্ভর) কাজ করেছেন। তাঁর অপেরা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সব কাজই সুর ও কথানির্ভর। প্রথম কথা, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর তুলনাই হতে পারে না। দুই, রবীন্দ্রনাথ ভাগনারের সমতুল্য নন—এটিও বিশ্রী ধারণা। একা একটি মানুষ ভারতবর্ষের পাঁচ-ছয় হাজার বছরের সংগীতের ইতিহাসের পেছনে দাঁড়িয়ে নিজেই একটি যুগ রচনা করেছেন, সংগীতের ধারা তৈরি করেছেন, যাঁর সঙ্গে অন্যদের কিছু মিললেও পুরো গানের ভুবনটি তাঁর একেবারেই আলাদা। মানুষটি ইতিহাসের ভেতরে থেকে, ইতিহাস থেকে বেরিয়ে নিজে ইতিহাস তৈরি করেছেন। তাঁকে পশ্চিমের চশমা দিয়ে দেখার দরকার নেই, তাঁকে দেখার চশমা হওয়া প্রয়োজন বাংলার চশমা। রবীন্দ্রনাথের নাটকের গান নিয়ে লেখা ‘রবীন্দ্র নাট্যসংগীত’ তিনি কোথায় কিভাবে লিখেছেন, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য বলেছি। ‘রবীন্দ্রসংগীত পরিক্রমা’য় তাঁর গানের সমগ্র আলোচনা করেছি। ‘রবীন্দ্রনাথ : গান রচনার ইতিহাস’-এ গান লেখার ইতিহাস এনেছি। খুব অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঢাকায় বসে যেটুকু কাজ করা সম্ভব হয়েছে, সেভাবেই গায়ক হিসেবে তিনি কত জনপ্রিয় ছিলেন সেটি নিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের গায়কখ্যাতি’ লিখেছি। তবে তাঁর ওপর আমার সবচেয়ে বড় কাজ হলো, ‘আর্ট অব টেগোর সংস’। তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বড় উৎসবের মাধ্যমে বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে ভারতীয় বাংলা সংগীতের ভুবনে তাঁর কীর্তি তুলে ধরেছি। বইটি লেখার সময় মনে হয়েছে, ইংরেজিতে লেখা এই বই সারা দুনিয়ার লোক পড়বে। ফলে তাদের এমন ধারণা হতেই পারে—তিনি শুধু গানের লোক। ফলে তাঁর সামগ্রিক অবদান নিয়ে বিরাট ভূমিকা লিখেছি। সাধারণত মানুষ মনে করেন, এমনকি আবু সয়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসুর মতো রবীন্দ্রসমালোচকও মনে করেন, তাঁর গানে কথাই প্রধান, সুর তার অনুগামী। তবে আমি বলেছি, কথার চেয়ে তিনি অনেক বড় সুর নির্মাতা। পদাবলি কীর্তনের ভাষা এখন বিস্মৃত। কেউ বোঝে না। তার পরও সুরের জন্য মানুষ এই গান শোনে। তেমনি ভাষার বিবর্তনে রবীন্দ্রনাথের ভাষা কখনো হারিয়ে গেলেও সুরের কারণে তাঁর গান সবাই শুনবে। বারবার সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি, তাঁর গানের দিকে চেয়ে দেখুন; কী তাঁর কথা, কী তাঁর সুর। বুদ্ধদেব বসু বলছেন, গীতাঞ্জলির কবিতাগুলোকে সুর দেওয়া হলো গোলাপের ওপর রং চরানো! গোলাপ তো এমনিই সুন্দর, এতে রং দেওয়ার কিছু নেই। আমি বলেছি, এটি বাজে কথা। এখনো বলছি, ‘জীবনে যত পূজা হলো না সারা/জানি হে জানি তাও হয়নি হারা’ যদি গান না হয়ে উঠত, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূর আমি ধাই’ যদি গান না হয়ে উঠত, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’ এমন কোনো কবিতাই নয়। কিন্তু সুরের জন্য গান হিসেবে সুন্দর। সুর তাঁর কবিতাকে গানের মর্যাদা দিয়েছে, অনুভব্য করেছে, আবেদনকে স্থায়ী করেছে। মানুষের প্রাণের সঙ্গে তাঁর যে ব্যথার গানগুলো গেঁথে আছে, সে শুধু কথার জন্য। তিনি বড় কবি, কথা মূল্যবান বটেই, কিন্তু সুর তাঁর কথাকে আরো মূল্যবান করেছে। তিনি বড় সুরের কবি। তা বোঝার সময় এখনো হয়নি। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার লিখিত জীবনে অনেক কিছু করেছি। কিছুটা ইঁদুরে খেয়েছে, কিছুটা বাদুড়ে খেয়েছে। কিন্তু আমার গান চিরকাল মানুষকে শুনতেই হবে। ’ তাঁর কবিতা যদি না পড়ে, তাহলে গান কেন শুনবে?

‘রবীন্দ্রনাথ, হান্টিংটন ও ভারত ভাগ’?

রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বক্তৃতা। নাম ‘সভ্যতার সংকট’। এই বক্তৃতাকে ব্যাখ্যার জন্য; এখানেও আমার দ্বিমত প্রকাশের জন্য ২৫০ পাতার বই লিখেছি। তাঁর সমালোচকরা বলেন, এতে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতাকে মন্দ বলেছেন। জীবনের শেষে এসে বুঝেছেন, পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করে, উপনিবেশ করে, শোষণ-অত্যাচার করে; ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় কী কদর্য, নির্মমতার মধ্যে ভারতবর্ষকে রেখে যাবে—এগুলো বলার জন্য তিনি বক্তৃতাটি দিয়েছেন। আমার মনে হয়েছে, কথাগুলো একেবারেই সত্য নয়। মোটেই তিনি তা বলেননি। বক্তৃতাটি তিনি কেন দিয়েছিলেন? তিনি তখন হাঁটতে পারছেন না, চোখে দেখছেন না, কানে শুনছেন না। তাঁকে ধরে ধরে বসানো হয়েছে। নিজে পড়তেও পারেননি। ক্ষিতিমোহন সেন পড়েছেন, তিনি চুপ করে বসে ছিলেন। কী কারণে এসব কথা বলেছেন? তাঁর বক্তৃতার প্রথম বাক্যেই সেটির সূত্র আছে। তিনি বলছেন, আজ আমার জীবনের ৮০ বছর পূর্ণ হলো। পেছন ফিরে পশ্চিম দিগন্ত থেকে পূর্ব দিগন্তের দিকে চেয়ে দেখতে পেলুম, আজ আমার জীবনের পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। কারণ দেশের মানুষের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। মানে ১৯৪০ সালে লাহোর রেজল্যুশন হলো, জিন্নাহ দ্বি-জাতিতত্ত্ব ঘোষণা করলেন, শেরে বাংলা ফজলুল হক সেটি পাঠ করলেন। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতবর্ষ অখণ্ড থাকবে না। পাকিস্তান হয়ে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে যাবে। হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি হয়ে যাওয়াকে তিনি বলছেন, তাঁর জীবন দুই টুকরা হয়ে গেছে এবং দেশের মানুষের মনোবৃত্তিও দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। কেউ আর একসঙ্গে থাকতে চাইছে না। অথচ সারা জীবন তিনি একত্রে থাকার জন্য কাজ করেছেন। ১৮৮৬ সালে কলকাতার সভায় নিজে গেয়েছেন, ‘মিলেছি আজ মায়ের ডাকে/ভাই হয়ে ভাই পরের মতন/ভাইকে ছেড়ে কদিন থাকে?’ হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই, তারা একত্রে থাকবে, পরের মতো থাকবে কেন? তাঁর মিলনবাদী ধারণা—ভারতবর্ষের সব মানুষ মিলেমিশে থাকবে, একত্রে থাকবে, তারা এক ভারত মাতার সন্তান। ভাগাভাগি হবে কেন? সেই তিনিই পরে দেখলেন, লাহোর রেজল্যুশন হয়ে গেছে, ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যাবে। ফলে বলছেন, আমার জীবন দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন, ভারতবর্ষের কপালে কী কষ্ট আসছে। স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস থিউরি মানে সভ্যতার সংঘর্ষ নামে একটি তত্ত্ব আছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকেও অনেকভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনিও মিলনের কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথও তাই সবচেয়ে বড় সত্য মানুষ। মানুষে মানুষে কিভাবে যোগাযোগ ও ঐক্য স্থাপন করা যায় সেই পটভূমি থেকে বইটি লিখেছি। এটি রবীন্দ্রনাথের ওপর আমার শেষ বই। আর লিখব না বলে ভাবছি। আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ওপর গবেষণার জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছে। নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে নজরুল পুরস্কার ও ২০১৩ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছি। ‘সংগীতকোষ’সহ দীর্ঘকালীন গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছি, ২০১২ সালে ‘একুশে পদক’। অনেকেই বলেন, দুজনের ওপর কাজ করে এমন লোক আর দেখিনি। আমি বলি, তাঁরা দুজনেই এক, শুধু একই সৌন্দর্যের দুই রকম প্রকাশ। দুজনেই মানুষের মঙ্গল, স্বাধীনতা চেয়েছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সংগ্রাম করেছেন। এই বইগুলোর দিকে যখন চেয়ে দেখি, খুব খুশি লাগে।

গান নিয়ে আরো বই লিখেছেন।

আমার ‘বাংলা গানের বিবর্তন প্রথম খণ্ড’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সূচনাকাল মানে চর্যাপদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, ১৯ শতক পর্যন্ত বাংলা গানের এক হাজার বছরের ইতিহাস এতে আছে। দিন-রাত লেখাপড়া করে করা এটি খুবই মৌলিক ও কঠিন কাজ। এটি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। এখন ভাবলে রীতিমতো ভয় হয়, কিভাবে কাজগুলো করতে পেরেছিলাম? আমি যে কাজগুলো করেছি, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এগুলোর কোনোটিরই পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। আগে সামান্য কিছু কাজ করা ছিল। তাই দেখে রাস্তা তৈরি করে এগোতে হয়েছে। ১৯৮৫ সালে আমাদের গানের ইতিহাসের সংক্ষিপ্তরূপ ‘বাংলা গান’ নামে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা গানের ইতিহাস আমিই লিখেছি। ‘ইভালুয়েশন অব বেঙ্গলি মিউজিক’ ৫০০ পৃষ্ঠার বই। এটিও বাংলা গানের ইতিহাস। ইংরেজিতে আর কারো এমন বই নেই। তখনো এসব বইয়ের রসদ কম ছিল, এখনো কমই আছে। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আট থেকে ১০ হাজার বই আছে। আর কিছু তো করতে পারিনি জীবনে, শুধু বই-ই কিনেছি। বই কিনি আর বই লিখি।

‘সংগীতকোষ’ কবে প্রকাশিত হয়েছে? এতে কী আছে?

লুটপাট হয়ে যাওয়ার পর আবার সব শুরু করতে হলো। সব বাধা অগ্রাহ্য করে সংগীতকোষের কাজ অব্যাহত রাখায় ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ‘সংগীতকোষ’ প্রকাশিত হলো। এতে বিশ্বসংগীতের যাবতীয় প্রধান জ্ঞাতব্য বিষয়, অর্কেস্ট্রা, সিম্ফোনি মানে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের প্রধান জ্ঞাতব্য বিষয়; হিন্দুস্তানি, কর্ণাটকি, দক্ষিণ ভারতীয় ফোক, নন-ফোক; ঘরানা, ঘরানার ইতিহাস; সেতার থেকে শুরু করে প্রধান বাদ্যযন্ত্রের বিবরণ; ৪০০-৫০০ রাগের বর্ণনাসহ সংগীতের হাজার চারেক এন্ট্রি আছে। শুধু সংগীতেরই নয়, যেকোনো অনুসন্ধিত্সু বাঙালির জন্য এটি রেডি রেফারেন্স।

গ্রোভস ডিকশনারি অব মিউজিকে আপনার লেখা আছে।

২০০০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত গ্রোভস ডিকশনারি অব মিউজিক অ্যান্ড মিউজিশিয়ানসের ৩০ খণ্ডের ভলিউম প্রকাশিত হয়। সেখানে বিশ্বের সব সংগীত ও সংগীতবিদদের জীবনী আছে। তাতে ৯ হাজার শব্দের বাংলা গানের ইতিহাসটি আমার লেখা। এর আগে ১৯৯৯ সালে গারল্যান্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ওয়ার্ল্ড মিউজিকে ‘দি সাউথ এশিয়ান সাব কন্টিনেন্ট’ ভলিউমে বাংলা গান নিয়ে ২৩ হাজার শব্দ লিখেছিলাম। পশ্চিম বাংলার অংশটুকুও আমার লেখা।

নজরুলের গানের খাতা কিভাবে উদ্ধার করেছিলেন?

দীর্ঘদিন ধরে আমরা জানতাম নজরুলের এক মামাতো ভাই পাকিস্তান হওয়ার পর অপশন দিয়ে সেখানে চলে গিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় অ্যাকাউন্টস সার্ভিসে ছিলেন। সেখানে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল হয়েছিলেন। এক পাঠান নারীকে তিনি বিয়ে করেছেন। তিনি পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। খবর পেলাম, এই ভাইয়ের কাছে কবির তিনটি গানের খাতা ছিল। পরে সেগুলো তাঁর স্ত্রীর কাছে ছিল। ঢাকা থেকে কে যেন গিয়ে দুটি খাতা নিয়ে চলে এসেছিলেন। সরকারি প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে ১৯৮৫ সালে ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছিলাম। সেখানে নজরুল গবেষণা সম্পর্কে জানাই ছিল উদ্দেশ্য। পাকিস্তানে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের পর তিনি এসে বললেন, এই একটি খাতা আমার কাছে আছে। খাতায় আমি সাড়ে ১৯ বা সাড়ে ২১টি নতুন গান পেয়েছিলাম। সেখানে পুরনো গানও ছিল। বলেছিলাম, খাতাটি আমাদের দিয়ে দিন। ঢাকায় গিয়ে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশ করব। তিনি নিজে ঢাকায় এসে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। তখন তাঁর অনেক বয়স। বাংলা বোঝেন না। পরে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে আমাদের দিলে সম্ভবত ‘গানের খেয়া’ নামের বইটি প্রকাশিত হয়।

নানা দেশের গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করেছেন।

নজরুল শতবর্ষে ১৯৯৯ সালে নর্থ আমেরিকার নজরুল সোসাইটি আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে তিন দিনের অনুষ্ঠান হয়েছে। আমি প্রধান বক্তা ছিলাম। ২০০২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস আমাকে ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডিসটিংগুইশ ভিজিটর হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বানারসের হিন্দু ইউনিভার্সিটির সংগীত বিভাগে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও বাংলা গানের ওপর বক্তৃতা দিয়েছি। ২০০৭ সালে কলকাতায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছি। সেখানে সংস্কৃতির নির্মাণ ও পুননির্মাণে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বলেছি। ২০১৪ সালে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে সাউথ এশিয়ান লেকচারের ৫০ বছর পূর্তিতে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আমাকে ‘টেগোর স্কলার’ হিসেবে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের আধুনিক সর্বজনীন আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছি। মাসদুয়েক পরে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে নজরুল বিষয়ে টানা দুই ঘণ্টার বক্তৃতা দিয়েছি। তিনি যে মিলনের কবি সেটি বলেছি। যখন যেখানে যাই, নজরুল মানুষে মানুষে মিল চাইতেন, এটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বলি। ২০১৬ সালে নিউ ইয়র্কে চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া সাধু শ্রী চিন্ময় ও রবীন্দ্রনাথের ওপর বক্তৃতা দিয়েছি। গত বছরই কানাডার টরন্টোতে নর্থ আমেরিকান অ্যানুয়াল নজরুল কনফারেন্সে কি-নোট পেপার পড়েছি। ২০১৭ সালে আমাকে নিউ ইয়র্কের বাঙালিরা নাগরিক সংবর্ধনা দিয়েছেন।

শ্রুতলিখন : শফিকুল ইসলাম

বিষেরবাঁশী ডেস্ক/সংবাদদাতা/হৃদয়

Categories: খোলা বাতায়ন,শিক্ষা,সারাদেশ,সাহিত্য

Leave A Reply

Your email address will not be published.